করোনার প্রভাব: মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরছেন হাজার হাজার শ্রমিক
2020.05.21
ঢাকা

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মীদের ফেরত পাঠাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স) এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছে সরকার ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বেনারকে জানান, “মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ২৯ হাজার বাংলাদেশি কর্মী ফেরত আসবে।”
সারা বিশ্বে অন্তত ১০-১৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মী বেকার হয়ে অন্ন, বস্ত্র, ও বাসস্থান সংকটে রয়েছেন বলে ধারণা করছেন ড. মোমেন।
“মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা খুব খারাপ। প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীর ৮৫ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত। মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো তেল। এখন তেলের দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড থেমে গেছে,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
“তাদের সবাই হয়তো ফিরবে না, তবে মোট কত লাখ ফেরত আসবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না,” জানান ড. মোমেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমাদের রিজার্ভের একটি বড় অংশ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের অর্থনীতি ব্যাপকাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
“এবার ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্সের লক্ষ্য থাকলেও করোনাভাইরাসের ফলে অনেকের চাকরি নেই, অনেক শ্রমিক ফিরে আসছেন। এতে প্রবাসী আয় কতটুকু কমবে জানি না। তবে মার্চ মাসে শুনেছি ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ কমেছে,” বলেন তিনি।
“প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ১ কোটি ২৩ থেকে ১ কোটি ৩০ লক্ষ বাংলাদেশি কর্মী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছেন,” বলেন ড. মোমেন।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে বিদেশে গেছেন সাত লাখ ১৫৯ কর্মী। চলতি বছরে সাড়ে সাত লাখ কর্মী পাঠানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করে সরকার। এ বছরের প্রথম দুই মাসে প্রায় এক লক্ষ ৩০ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন। করোনার কারণে মার্চ থেকে কর্মী পাঠানো বন্ধ রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ—সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বেনারকে বলেন, “মধ্যপ্রাচ্য এখন আমাদের জন্য দ্বিমুখী সংকট তৈরি করছে। এখন সেখানে কাজ নেই। আবার তেলের চাহিদা কমায় করোনাত্তর সময়েও স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফিরতে তাদের সময় লাগবে।”
“ফলে মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিককে চলে আসতে হতে পারে। এটা বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ। আবার নতুন শ্রমিক যাওয়াও কমে যাবে। ফলে সেই চাপও দেশের কর্মসংস্থানে পড়বে,” বলেন তিনি।
দেশের অর্থনীতিতে এর বড় প্রভাব পড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ফেরত আসাদের জন্য দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ করতে হবে। কৃষি খাতকে সচল রাখতে হবে।”
এ ছাড়া কর্মীদের সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে রাখার বিষয়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে বলেও মনে করেন গোলাম মোয়াজ্জেম।
উল্লেখ্য, বিশ্ব ব্যাংক পূর্বাভাস অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের কারণে এ বছর সারাবিশ্বে রেমিটেন্স কমবে ২০ শতাংশ। আর বাংলাদেশে কমবে ২২ শতাংশ।
ইতিমধ্যে তার প্রমাণও মিলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের এপ্রিলে ১০৪ কোটি ১০ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে এর পরিমাণ ছিল ১৪৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।
এ ছাড়া গত মার্চের তুলনায় এপ্রিল রেমিটেন্স কমেছে ২৪ কোটি ডলার। গত মার্চ মাসে প্রবাসীরা ১২৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন।
ফেরত পাঠাচ্ছে যেসব দেশ
জনশক্তি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাব অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যের আট দেশেই বেশির ভাগ বাংলাদেশি কর্মীরা থাকেন। এসব দেশ থেকে প্রবাসী আয়ের অর্ধেকের বেশি আসে।
করোনা সংক্রমণ শুরুর পর গত ১৬ মার্চ থেকে ১৩ মে পর্যন্ত ৩ হাজার ১৭৬ কর্মী বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরেছেন বলে বেনারকে জানান বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক অনুবিভাগের মহাপরিচালক এফ এম বোরহান উদ্দিন বেনারকে বলেন, “গালফের কিছু দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, ইরাক, লেবানন—এসব দেশ থেকেই মূলত কর্মীরা ফেরত আসছেন।”
তাঁর মতে, “শুধু করোনাভাইরাসের জন্য নয়, এসব দেশে ‘আনডকুমেন্টেড’ কর্মীরা নিয়মিত ফ্লাইটে ফেরত আসে। বেশ কিছুদিন ধরে বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ থাকায় সংখ্যা বেড়ে গেছে।”
“ফলে তারা বিশেষ ফ্লাইটে করে কর্মীদের ফেরত পাঠাচ্ছে। তা ছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে অনেক কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে। অনেক লোক চাকরি হারাচ্ছে। তাদেরও চলে আসতে হচ্ছে,” বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা।
“করোনার চেয়ে তেলের দাম কমে যাওয়াটা আমাদের বেশি বিপদে ফেলেছে” উল্লেখ করে বোরহান উদ্দিন বলেন, “সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ মনে হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়তো আবার সম্ভাবনা থাকবে।”
জর্ডানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান বেনারকে বলেন, “কিছুদিন আগে জর্ডান সরকার সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে অনিয়মিত কর্মীদের দেশে ফেরার সুযোগ করে দিয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কারখানা থেকে চাকরি হারিয়েছে অনেক কর্মী। তারা দেশে ফেরত যাবে। যদিও সংখ্যাটি এখনই নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না।”
তিনি জানান, জর্ডানে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে ৪৫ হাজার কর্মী তৈরি পোশাক খাতে কাজ করেন।
মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন প্রবাসীরা
সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশের রফিকুল ইসলাম টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “১০ মাস আমাদের কোনো বেতন নেই। পাঁচ মাস বিদ্যুত নেই। প্রচণ্ড গরমে চার-পাঁচদিন পর্যাপ্ত পানি পাই না। ৫০ জন বাংলাদেশি এমন মানবেতর জীবন যাপন করছি মাসের পর মাস।”
কুয়েতের ছেবদি প্রত্যাবাসন ক্যাম্প থেকে আশরাফুল ইসলাম নামে একজন বাংলাদেশি কর্মী বেনারকে জানান, “সাধারণ ক্ষমায় দেশে ফেরাবে বলে আমাদের এখানে জড়ো করে রাখা হয়েছে এক মাস ধরে। এখানে গাদাগাদি করে থাকছি, একবেলা খাবার পাচ্ছি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে দেশে ফেরার আগেই মারা যাব।”
বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ নোমান বেনারকে বলেন, “সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং সৌদি আরবে সংক্রমিতদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশি কর্মী। তাঁদের জীবন যাপনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো সুযোগ নেই। আর তারা সেটা মানছেও না।”
“এজন্য এসব দেশের সরকার এ ধরনের কর্মীদের পাঠিয়ে দিচ্ছে” জানান তিনি।
কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “গত মঙ্গলবার থেকে কুয়েত বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো শুরু করেছে। এক মাসের মধ্যেই কুয়েতের বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা প্রায় পাঁচ হাজার বাংলাদেশিকে দেশে পাঠানো হবে।”
তিনি বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই গত মাসে অনিয়মিত অভিবাসীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে কুয়েত সরকার। এই পাঁচ হাজার বাংলাদেশি এই সুযোগ নিয়ে দেশে ফেরার আগ্রহ প্রকাশ করলে কুয়েতের বিভিন্ন অস্থায়ী ক্যাম্পে তাদের গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে।”
ছয় মাস ছাঁটাই না করার অনুরোধ
সরকারের কর্মকর্তারা জানান, চলমান সংকট সমাধানে প্রবাসীকল্যাণ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করছে। ফেরত আসা কর্মীদের পুনর্বাসনের জন্য প্রশিক্ষণ ও কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বেনারকে বলেন, “প্রবাসী শ্রমিকেরা চাকুরিচ্যুত হলেও যাতে কমপক্ষে ছয় মাসের বেতন ও অনুষঙ্গিক সুবিধা পায়, সে জন্য আমরা বিভিন্ন দেশের সাথে আলোচনা করছি। তবে আরব দেশগুলো থেকে এ বিষয়ে আশাব্যঞ্জক সাড়া মেলেনি।”
মন্ত্রী বলেন, “বিভিন্ন দেশ থেকে কয়েক হাজার লোক ফিরলে আলাদা কথা, কিন্তু কয়েক লাখ ফিরলে বিরাট সমস্যা হবে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা চাওয়া হয়েছে।”
এদিকে বিদেশ থেকে আসা যেকোনো কর্মীকে অবশ্যই স্বাস্থ্য পরীক্ষার ভিত্তিতে ১৪ দিনের প্রতিষ্ঠানিক অথবা হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা নিশ্চিত করা হচ্ছে বলে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বোরহান উদ্দিন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে বাংলাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ২২ জন, নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৭৭৩ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১২ মে থেকে গত দশ দিনে বাংলাদেশে প্রতিদিন গড় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল এক হাজার ২৮২ জন। এর মধ্যে সর্বনিম্ন ৯৩০ জন ছিল গত ১৬ মে আর সর্বোচ্চ ১,৭৩৩ জন আক্রান্ত শনাক্ত হন বৃহস্পতিবার।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৪০৮ জন, মোট আক্রান্ত ২৮ হাজার ৫১১ জন।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৫০ লাখ ৪৭ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন তিন লাখ ২৯ হাজারের বেশি।