টিআইবির গবেষণা: বেআইনিভাবে তৃতীয় পক্ষকে যুক্ত করায় করোনা টিকার খরচ বেশি
2021.06.08
ঢাকা

ভারত থেকে করোনাভাইরাসের টিকা আমদানিতে বেআইনিভাবে তৃতীয় পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করায় বাংলাদেশকে তুলনামূলক বেশি টাকা খরচ করতে হয়েছে বলে মঙ্গলবার প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলা: কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে জার্মানভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চ্যাপ্টার টিআইবি।
এতে বলা হয় করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় টিকা ক্রয়সহ অন্যান্য কেনাকাটা এবং এ সংক্রান্ত সার্বিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পারেনি সরকার।
কোভিড মোকাবেলায় বিভিন্ন হাসপাতালের বরাদ্দ ব্যয়ে দুর্নীতি অব্যাহত থাকার কথাও বলা হয় গবেষণায়।
টিআইবি’র এই প্রতিবেদন প্রকাশের একদিন আগে সোমবার দেশের জাতীয় সংসদে টিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধে সরাসরি বিভিন্ন অভিযোগ তোলেন। যদিও মন্ত্রী এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
‘স্বচ্ছতার ঘাটতি’
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি টিকা কেনার জন্য গত ডিসেম্বরে চুক্তি করে বাংলাদেশ। এতে সরবরাহকারী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশের বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মা।
“বাংলাদেশ সরকার, বেক্সিমকো এবং সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যেকার টিকা ক্রয় চুক্তি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ঘাটতি ছিল প্রকট। টিকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়বিধি অনুসরণ করা হয়নি,” বলা হয় প্রতিবেদনে।
“যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে” টিকা আমদানিতে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বেক্সিমকোকে অন্তর্ভুক্ত করায় অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি মূল্যে বাংলাদেশকে সেরামের টিকা কিনতে হয়েছে মন্তব্য করে এতে বলা হয়, “সরকার সরাসরি সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে টিকা আনলে প্রতি ডোজে যে টাকা বাঁচত তা দিয়ে ৬৮ লাখ বেশি টিকা ক্রয়ের চুক্তি করা যেত।”
“একটি উৎস থেকে ক্রয়ের ক্ষেত্রে দর-কষাকষির নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি,” বলা হয় এতে।
টিআইবির মতে, “ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত প্রতিনিধিদের মধ্যে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাও আছেন, যা আইনের লঙ্ঘন।”
“নীতিমালা লঙ্ঘন করে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় টিকা আমদানি করে তৃতীয় পক্ষকে লাভবান হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। যার বোঝা জনগণকে বইতে হচ্ছে,” গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশকালে বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
“ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর প্রভাব ও রাজনৈতিক বিবেচনায় টিকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে একক উৎসের ওপর নির্ভর করার কারণে চলমান টিকা কার্যক্রমে আকস্মিক স্থবিরতা নেমে এসেছে,” বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাপে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একটি উৎস ছাড়া বিকল্প উৎস অনুসন্ধানে উদ্যোগেরও ঘাটতি ছিল।
এ প্রসঙ্গে টিআইবির কোনো অভিযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মন্তব্য না করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক মঙ্গলবার বেনারকে বলেন “টিআইবির এই বক্তব্য তাদের নিজস্ব এবং কোনো প্রকার প্রমাণ ছাড়াই তারা এসব তথ্য উপস্থাপন করেছে।”
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ সরকার করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে নিয়ে সার্বিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কেউই পার পাচ্ছে না।
অন্যদিকে “টিআইবি তাদের প্রতিবেদনটি পাঠালে তা বিশ্লেষণ করে” মন্ত্রণালয় থেকে “প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ” নেয়া হবে বলে বেনারকে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন হাসপাতালের কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বরাদ্দ ব্যয়ে দুর্নীতি অব্যাহত রয়েছে। পাঁচটি হাসপাতালে ক্রয়, কর্মী নিয়োগ এবং ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কোয়ারেন্টাইন বাবদ ৬২ কোটি ৩ লাখ টাকা ব্যয়ের বিপরীতে ৫ কোটি টাকা দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে।
টেস্টিং কিট ক্রয়; দরপত্র মূল্যায়ন ও কার্যাদেশ প্রদানের ক্ষেত্রেও অনিয়মের আলামত পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয় টিআইবির এই প্রতিবেদনে।
তবে এই অভিযোগগুলোর সঙ্গে একমত নন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানেরা বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন।
ব্যাপক তৎপরতার কারণেই বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু এবং সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে বলে জানান তিনি।
দুর্নীতি নয়, তথ্য নিয়ন্ত্রণ
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “কোভিড-১৯-এর শুরু থেকে সরকারের তথ্য নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা বেশি ছিল, সাংবাদিক রোজিনা ইসলামসহ বেশ কিছু এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। সরকার দুর্নীতি রোধের চেয়ে তথ্য নিয়ন্ত্রণে শতভাগ বেশি সক্রিয় ছিল।”
টিআইবির রিসার্চ ফেলো মো. জুলকারনাইন গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন, যেখানে দেখা যায়, করোনা মহামারিতেও সারাদেশে ৮৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এ সময় করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে লেখালেখির অপরাধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক একজন লেখকের কারাগারে মৃত্যু হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০২০ সালে ২৪৭ জন সাংবাদিক আক্রমণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন করা সাংবাদিক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তথ্য সংগ্রহের সময় নির্যাতনের শিকার ও আটকের শিকার হন। পরে তাঁর বিরুদ্ধে অযৌক্তিকভাবে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩-এ মামলা দায়ের করে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিগত এক বছরেও সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শৈথিল্য লক্ষ করা গেছে। কিছু ক্ষেত্রে মামলা দায়ের ও কিছু ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের রদবদলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা গেছে।
দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আইনের আওতায় আনা হয়নি, বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ভারত থেকে কেনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকার মাধ্যমে গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে গণ টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। চুক্তি অনুযায়ী সেরাম থেকে জুন মাসের মধ্যে মোট তিন কোটি টিকা আসার কথা থাকলেও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭০ টিকা আসার পর আর কোনো টিকা পায়নি বাংলাদেশ।
এর বাইরে ভারত সরকারের উপহার হিসেবে তিন দফায় বাংলাদেশ পেয়েছে ৩৩ লাখ ডোজ টিকা।
অপরদিকে গত মাসে চীন সরকার থেকে ৫ লাখ ডোজ টিকা উপহার এসেছে। এই টিকা ২৫ মে থেকে প্রয়োগ শুরু হয়েছে। আরও ৬ লাখ ডোজ অনুদান হিসাবে শিগগিরই পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
করোনার টিকা সংগ্রহ ও বিতরণের বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স থেকে সম্প্রতি দেশে পৌঁছেছে ফাইজারের ১ লাখ ৬২০ ডোজ টিকা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন আট লাখ, ১৫ হাজার ২৮২ জন, মৃত্যু হয়েছে ১২ হাজার ৯১৩ জনের।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ কোটি ৩৭ লাখ ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ৩৭ লাখ ৪০ হাজারের বেশি।