করোনার ভয়ে ঢুকতে দিচ্ছে না কেউ, কাজ হারিয়ে কষ্টে আছেন গৃহকর্মীরা

প্রাপ্তি রহমান
2020.06.10
ঢাকা
200610_corona_1000.jpg করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে দুই সপ্তাহের জন্য রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার এলাকা ‘রেড জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম দিন এক ব্যক্তি হাত জোড় করে এলাকায় ঢোকার জন্য পুলিশকে অনুরোধ জানাচ্ছেন। ১০ জুন ২০২০।
[ফোকাস বাংলা]

করোনাভাইরাস মহামারিতে কাজ হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন দেশের কয়েক লাখ গৃহকর্মী। আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন শ্রমিকদের এই দলটি, যাদের বেশিরভাগই শহুরে এবং নারী।

গৃহকর্মীরা বলছেন, ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে নিয়োগকারীরা এখন একদিকে যেমন বাইরের কাউকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছেন না, তেমনি বহু মানুষ শহর ছেড়ে চলে যাওয়ায় কাজের সুযোগও কমে গেছে অনেক।

“এখন আর তারা বাইরের কাউরে ঢুকাইতে চায় না, রান্না করাইতেও চায় না,” বুধবার বেনারকে বলেন ঢাকার ইন্দিরা রোডের মেসবাড়িতে রান্নার কাজ করা শাহনাজ আক্তার।

শাহনাজ জানান, আগে প্রতিদিন তিনি বিভিন্ন মেসবাড়িতে অন্তত ত্রিশজনের রান্না করতেন। করোনাভাইরাসে অনেকে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ায় সেই সংখ্যা এখন পাঁচে নেমে এসেছে, কমে গেছে তাঁর আয়ও।

আগে তাঁর ছয়জনের সংসারে খাওয়া-পরার পরও হাজার দুয়েক টাকা হাতে থাকত। এখন আর পেটই চলছে না বলে জানান শাহনাজ।

বুধবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে মৃতের সংখ্যা এক হাজার অতিক্রম করার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এই পরিস্থিতিতে বেড়েছে মানুষের ভয় ও আতঙ্ক, আয় বন্ধ হয়ে গেছে গৃহকর্মীদের।

শাহনাজের মতো একই অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন কলাবাগানের বাসিন্দা আনোয়ারা আনু। স্বামী পরিত্যক্তা আনোয়ারা পান্থপথের একটি বহুতল ভবনের একাধিক ফ্ল্যাটে কাজ করছেন একযুগেরও বেশি সময় ধরে।

কিন্তু করোনাভাইরাসের ভয়ে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির নির্দেশে এখন ভবনে ঢোকা নিষেধ হয়ে গেছে তাঁর। ফ্ল্যাটের লোকজন তাঁকে চাল, ডাল, আলু, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে বিদায় করে দিয়েছেন।

সরকার সাধারণ ছুটি উঠিয়ে দিলেও সংক্রমণের ভয়ে এখন আর কেউ গৃহকর্মী রাখতে চাচ্ছে না বলে জানান আনোয়ারা।

তিনি বলেন, “ঢুকবার দেয় না কেউই। চাল-ডাল দিছে, কিন্তু আমার তো বাসা ভাড়া দিউন লাগব। বাসাত মানুষ তো কম না। তারারে কইলাম, লকডাউন তো আর দিত না, অহন আইলে সমস্যা কী, তারা কয় অসুখ হইব।”

বাংলাদেশে গৃহস্থালী কাজের সঙ্গে কত মানুষ জড়িত তার হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী গৃহস্থালী কাজের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ লাখ। যাদের প্রায় ৭০ শতাংশই কাজ করেন শহরে এবং বাকিরা গ্রামাঞ্চলে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)র হিসেবে বাংলাদেশে এই পেশায় যুক্তদের ৯০ শতাংশই নারী ও কন্যাশিশু।

অর্থনৈতিক সুরক্ষার নেই
বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় কোনো আইন নেই। আছে ডমেসটিক সার্ভেন্টস রেজিস্ট্রেশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১। এই অধ্যাদেশের কারণে কাজে ঢোকার আগে গৃহকর্মীদের স্থানীয় থানায় গিয়ে নাম-ঠিকানা নিবন্ধন করাতে হয়।

তবে গৃহকর্মীর অধিকারের বিষয়টি এতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

এর বাইরে বছর কয়েক আগে গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করেছে সরকার। এতে বলা হয়েছে, কেউ কাজ করতে না চাইলে বা কাউকে কাজ থেকে বাদ দিতে হলে এক মাসের নোটিশ দিতে হবে। নোটিশ না দিলে এক মাসের মজুরি দিয়ে ছাঁটাই করা যাবে।

তবে দীর্ঘমেয়াদে গৃহকর্মীদের ভরণপোষণের বিষয়ে নিয়োগকর্তাদের কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই বলে বেনারকে জানান শ্রম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড রেজাউল হক।

তিনি বলেন, “মহামারির সময়ে গৃহকর্মী ছাঁটাই করলেও তাঁদের অর্থনৈতিক সুরক্ষাটা যেন দেওয়া হয়, সেজন্য বড়জোর নিয়োগকর্তাদের বলা যায়। কাউকে বাধ্য করতে গেলে আইন দরকার। আমাদের কোনো আইন নেই।”

আলাদাভাবে গৃহকর্মীদের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ত্রাণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি বলেও জানান তিনি।

রাজধানীর লালমাটিয়ায় দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিতরণ করছেন একদল তরুণ। তাঁদের একজন সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন।
সাইফুল বেনারকে জানান, বড় বড় শপিংমল, ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তারক্ষীদের খাওয়া-দাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাঁদের কথা মাথায় রেখে তাঁরা খাদ্যসহায়তা দিতে শুরু করেছিলেন।

তিনি বলেন, “প্রথম প্রথম আশপাশের ভবনের নিরাপত্তারক্ষী, রিকশাচালকরা আসতেন। এখন যারা আসছেন তাঁদের বড় অংশই ছাঁটাই হওয়া গৃহকর্মী।”

সরেজমিনে পূর্ব রাজাবাজার

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অধিক সংক্রমণ ঘটার এলাকাগুলোতে কঠোরভাবে লক-ডাউন জারির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। প্রথমেই লকডাউন করা হয়েছে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার।

মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকে পূর্ব রাজাবাজার লকডাউন করে দেওয়া হয়। বাঁশের ফটক তৈরি করে যাওয়া-আসা দুই-ই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, এ এলাকার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার।

বুধবার সকালে পূর্ব রাজাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রবেশ পথে কাউন্সিলর অফিসের উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবীরা ফটক পাহারা দিচ্ছেন, তাঁদের সহযোগিতা করছে পুলিশ।

“আমরা পরিচয়পত্র দেখে শুধুমাত্র যারা হাসপাতাল বা অন্যান্য জরুরি সেবাখাতে যুক্ত তাঁদের ঢুকতে-বেরোতে দিচ্ছি,” বেনারকে বলেন মো. শাওন নামে একজন স্বেচ্ছাসেবী।

এলাকার কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান ইরান বেনারকে বলেন, তাঁরা চান এলাকাবাসী নিজ স্বার্থে লকডাউনের নিয়মগুলো মেনে চলুক।

“ছোট্ট একটা মহল্লায় ৩১ জন পজিটিভ, তাও মানুষ সিরিয়াস হচ্ছে না। আমরা দরিদ্রদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা রেখেছি, যারা কিনে খেতে পারবে তাদের ঘরে টাকার বিনিময়ে খাবার পৌঁছে দেবো,” বলেন ফরিদুর রহমান।

এই মহল্লায় সারাদিনই দোকানপাট বন্ধ ছিল। একটি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে একটি নম্বর। এই নম্বরে যোগাযোগ করে উপসর্গ আছে এমন ব্যক্তি পরীক্ষা করাতে পারবেন।

বুথে দিনে ৩০টি নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে জানান স্থানীয় কাউন্সিলর।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসেবে, আক্রান্তের দিক থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের পরেই এখন বাংলাদেশের অবস্থান।

সারা বিশ্বে ১৯তম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশে গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৩১৯০ জন। এ নিয়ে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৭৪ হাজার ৮৬৫ জন। ৮৪ হাজারের কিছু বেশি আক্রান্ত নিয়ে তালিকার ১৮তম স্থানে রয়েছে চীন।

একই সময়ে ৩৭ জন মারা যাওয়ায় করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১২ জনে।

জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৭২ লাখ ৯১ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন চার লাখ ১৩ হাজারের বেশি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।