করোনা সংকটে হুমকিতে হকারদের জীবন ও জীবিকা
2020.06.12
ঢাকা

পান্থপথ থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে যে সড়কটা চলে গেছে তার এক কোনায় ছোট একটা দোকান নিয়ে বসতেন আঙ্গুরি বেগম। ঘরে তৈরি খাবার বিক্রি করতেন। লকডাউনের পর ঢাকা ছেড়েছেন। জীবন-জীবিকা দুই-ই এখন হুমকির মুখে।
রাজধানী ঢাকার প্রায় চার লাখ হকারের একজন আঙ্গুরি। সড়কে তিনি যে জায়গাটায় বসতেন, ঠিক তার পেছনে চায়ের একটা ভ্রাম্যমাণ দোকান ছিল, পাশে আরেকটি খাবার গাড়ি। উল্টো পাশে সেদ্ধ ডিম বিক্রি করতেন এক বৃদ্ধ, তাঁর পাশে ডাব বিক্রেতা। শুক্রবার এদের কাউকেই দেখা যায়নি।
শুক্রবার কথা হচ্ছিল আঙ্গুরি বেগমের সঙ্গে। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে স্বামী-সন্তান নিয়ে চলে গেছেন।
“ভালাই চলতাছিল, দেড় হাজার-দুই হাজার টাকা বেচতাম। দুইশ কম আট হাজার বাসা ভাড়া দিয়াও হাতে কিছু থাকত,” জানিয়ে আঙ্গুরি বেগম বেনারকে বলেন, “এখন বাড়িত বওয়া। কেমনে কী করতাম।”
ঈশ্বরগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে কোনো কাজ নেই বলে জানান আঙ্গুরি। তিনি জানান, অল্পস্বল্প কিছু টাকা জমিয়েছিলেন, ঈদে কিছু সাহায্য পেয়েছেন। এই সম্বল নিয়ে কোনোরকমে চলছে। এতে আরো একমাস চলবে বলে মনে হয় না।
১৫ মে লকডাউন কিছুটা শিথিল হওয়ায় ঢাকায় ফিরেছেন ফল বিক্রেতা জলিল মিয়া। দুই দশক ধরে পুরান ঢাকার ফলের আড়ৎ থেকে ফল এনে কলাবাগানে একটা ছোট ফার্মেসির সামনে বসেন। তাঁরও দিন চলে না এখন।
আলাপচারিতার শুরুতেই অল্প কিছু টাকা ঋণ দেবে এমন কেউ আছেন কি না জানতে চান জলিল।
“অল্প কয়ডা টাকা হইলেই চলতাম ফারতাম। অ্যাক্কেরে চলতাছে না। দেশে (গ্রামের বাড়ি) চলতাছে না দেইখা ঢাকায় আইছি। পারতাছি না আর। বিক্রি ভালা না,” বেনারকে বলেন জলিল।
জলিলের মতো অনেকেই ঢাকায় ফিরেছেন। ফার্মগেট, গুলিস্তান বা নিউমার্কেটে আবারও পসরা সাজিয়ে বসেছেন। কিন্তু ক্রেতা নেই।
বছরের পর বছর যানজটের শহর ঢাকায় হকার থাকবেন কি থাকবেন না, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করেছে, আবারও কিছুদিন বাদে হকাররা তাঁদের পসরা সাজিয়ে বসেছেন রাস্তার ধারে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর এখন ঢাকা প্রায় হকারমুক্ত।
বাংলাদেশ হকার্স সমিতির হিসেবে দেশে ভ্রাম্যমাণ এসব খুদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় বিশ লাখ। তাঁদের চার লাখ থাকেন ঢাকায়।
কথা হচ্ছিল বাংলাদেশ হকার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো সেকান্দার হায়াৎ এর সঙ্গে। তিনি বলেন, নগদ অর্থ সহায়তা ছাড়া হকারদের বাঁচানো সম্ভব না।
তিনি বলেন, “প্রথম মাসে পুঁজি ভেঙে খেয়েছি। অর্থ সহায়তা কিংবা রেশন কার্ডের জন্য নানা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। আড়াইহাজার টাকা করে সরকারের ত্রাণ সহায়তার জন্য দেড় হাজার হকারের নাম লিখিয়েছিলাম। একজনও পায়নি।”
দেশের দরিদ্র মানুষ ও করোনাভাইরাসের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়াদের বিশেষ ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। তবে তাতে আলাদাভাবে হকারদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই বলে জানান কর্মকর্তারা।
মন্ত্রণালয়ের সচিব মো জয়নুল বারী বেনারকে বলেন, “ঢাকার ভেতরে প্রতিদিন দেড় হাজার মানুষকে শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। জেলায় যেসব অফিস রয়েছে, সেগুলোও অর্থ সহায়তা দিচ্ছে।”
তবে বিশেষ কোনো পেশার লোকজনকে আলাদাভাবে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
মহামারি ঠেলে দেবে অর্থনৈতিক সংকটে
নিম্ন ও নিম্ন–মধ্যবিত্তদের জন্য কোথাও কোনো আশার কথা নেই। শুক্রবার লন্ডনের কিংস কলেজ ও অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী দরিদ্রের সংখ্যা আবারও একশ কোটি ছাড়াবে।
বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান এবং ফিলিপাইন এই মহামারিতে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে জানানো হয় ওই প্রতিবেদনে।
“এই মহামারি দ্রুতই উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিক সংকট হিসেবে দেখা দিতে পারে,” বলেন কিংস কলেজ, লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক অ্যান্ডি সামার।
গবেষণাপত্রের সহরচয়িতা অ্যান্ডি সামার আরও বলেন, বৈশ্বিকভাবে দারিদ্র্য কমিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সেটি ২০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারে।
ইউনাইটেড ন্যাশনস ইউনিভার্সিটি ওয়ার্ল্ড ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস এর এই রিসার্চে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী চরম দরিদ্র মানুষ অর্থাৎ যাদের দৈনিক আয় এক দশমিক নয় শূন্য ডলারের (প্রায় ১৬১ টাকা) কম, বর্তমানে তাঁদের সংখ্যা ৭০ কোটি। তবে সংখ্যা একশ কোটিতে পৌঁছাতে পারে।
আবারও সর্বোচ্চ শনাক্ত, মৃত্যুও সর্বোচ্চ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে দেশে আবারও সর্বোচ্চ শনাক্ত ও মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ৪৭১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৪৬ জন।
এ নিয়ে এখন পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৮১ হাজার ৫২৩ জন। মারা গেছেন এক হাজার ৯৫ জন।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ জানাচ্ছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর রোগটির উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ৮৬১ জন।
গত ১১ জুন প্রতিষ্ঠানটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানায়।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৭৫ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন চার লাখ ২২ হাজারের বেশি।
আরও দুই চিকিৎসকের মৃত্যু
শুক্রবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মাহমুদ মনোয়ার (৪৩) নামে একজন হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ মারা গেছেন।
দুই মাস আগে মাহমুদ মনোয়ার তাঁর ফেসবুকে চিকিৎসকদের সাবধান থাকার কথা জানিয়ে পোস্ট দিয়েছিলেন।
তিনি লেখেন, “একটি মৃত্যু ট্র্যাজেডি, কিন্তু যখন মৃত্যু সংখ্যা লাখ ছাড়ায় তখন তা হয় শুধু পরিসংখ্যান। পরিসংখ্যানের অংশ হতে না চাইলে সাবধানে থাকুন।”
জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে মাহমুদ মনোয়ারের সহকর্মীরা জানান, চার দিন আগে তাঁর রোগ শনাক্ত হয়। বৃহস্পতিবার রাতে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়।
এছাড়া বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সোয়া একটার দিকে মারা যান শিশু সার্জারি বিশেষজ্ঞ হাজী জহির হাসান।
এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বাংলাদেশ ডক্টরস ফেডারেশনের মুখপাত্র নিরুপম দাশ বেনারকে বলেন, “এই নিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৮ চিকিৎসক মারা গেলেন। আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে।”