করোনায় ৪২ চিকিৎসকের মৃত্যু: নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রীকে দায়ী করছে বিএমএ
2020.06.19
ঢাকা

অপর্যাপ্ত এবং নিম্নমানের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর (পিপিই) কারণেই করোনাভাইরাসে বেশি সংখ্যক চিকিৎসকের মৃত্যু হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ সংগঠন বাংলাদেশে মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন—বিএমএ।
যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষে রোগতত্ত্ব বিভাগের অপ্রকাশিত গবেষণা বলছে, পিপিই সঠিকভাবে পরা ও না খোলার কারণেই চিকিৎসকরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। নিম্নমানের পিপিই সরবরাহের বিষয়টি তাঁরা স্বীকার করছেন না।
এই গবেষণাকে নাকচ করে দিয়ে বিএমএর সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, “নিম্নমানের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) সরবরাহ করা এবং সময়মতো প্রয়োজনীয় চোখ রক্ষাকারী চশমা না দেয়ায় এত সংখ্যক চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন।”
তিনি বলেন, চিকিৎসা দিতে গিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেখানে শতকরা দুই দশমিক পাঁচজন ডাক্তার করোনাভাইরাসে প্রাণ হারান। সেখানে বাংলাদেশে এই হার প্রায় সাড়ে চার। এজন্য তিনি দুষছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কেন্দ্রীয় ঔষাধাগারকে।
এ পর্যন্ত ৪০ জনের বেশি ডাক্তার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ বেনারকে বলেন, “এটি আমাদের জন্য অনেক বড় ক্ষতি।”
“কেন এত সংখ্যক চিকিৎসক মারা গেলেন সে ব্যাপারে আমরা রোগতত্ত্ব বিভাগকে গবেষণার দায়িত্ব দিয়েছি। তারা গবেষণা করে দেখছে,” বলেন তিনি।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এত বেশি সংখ্যক ডাক্তার মারা যাবার বিষয়ে তাঁরা গবেষণা করছেন বলে বেনারকে জানান রোগতত্ত্ব বিভাগের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে যা মনে হচ্ছে তা হলো, দুটো কারণে হতে পারে। পিপিই সঠিকভাবে পরিধান করা হয়নি। অথবা পিপিই সঠিকভাবে পরিধান করা হয়েছিল, কিন্তু খোলার সময় তা সঠিকভাবে খোলা হয়নি।”
তিনি বলেন, “ডাক্তাররা রোগীদের সেবা দেয়ার পর ক্লান্ত থাকেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন। ব্যবহারের পর পিপিইতে করোনাভাইরাস থাকে। তখন হয়তো তাড়াতাড়ি খুলতে গিয়ে তাঁরা আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন।”
গবেষণা তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানো হবে বলে জানান ডা. ফ্লোরা।
তবে ডাক্তাররা সঠিকভাবে পিপিই ব্যবহার না করায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন রোগতত্ত্ব বিভাগের এমন দাবির সাথে দ্বিমত করে সরবরাহ করা পিপিই সরঞ্জামের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএমএ মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী।
“ডাক্তাররা খুব ভালো করে জানেন কীভাবে পিপিই ব্যবহার করতে হয়,” মন্তব্য করে ডা. ইহতেশামুল বলেন, “স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় ঔষধাগার আমাদের যে পিপিই দিয়েছিল সেগুলো সাধারণ কাপড় এবং কখনও ছাতা তৈরির কাপড় দিয়ে তৈরি ছিল। এগুলো দিয়ে একজন চিকিৎসক করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন না।”
“আবার উনারা (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) বলে যাচ্ছিলেন তাঁরা লাখ লাখ পিপিই সরবরাহ করেছেন। কিন্তু দেশের অনেক হাসপাতালে পিপিই ছিল না। ডাক্তাররা অরক্ষিত অবস্থায় চিকিৎসা দিয়েছেন,” অভিযোগ করেন তিনি।
ডা. ইহতেশামুল হক বলেন, “চিকিৎসকদের চোখ রক্ষার জন্যও কোনো মাস্ক দেয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি অনুধাবন করে নারায়ণগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে ভালো মানের পিপিই এবং মাস্ক দেয়ার কথা বলেন।”
“এরপরই পরিস্থিতি পরিবর্তন হলো; ভালো মানের পিপিই দেয়া হলো। সরিয়ে দেয়া হলো অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় ঔষধাগার প্রধানসহ আরও কয়েকজনকে,” বলেন তিনি।
বিএমএর হিসাবে, করোনাভাইরাসে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারা দেশে মোট ৪১ জন চিকিৎসক প্রাণ হারিয়েছেন। আরও একজন ডাক্তার মারা গেছেন, যিনি বিএমএ সদস্য নন।
এই সময়ে সারা দেশে আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৪০ জন চিকিৎসক, নয়’শ একজন নার্স এবং এক হাজার ৩৬০ জন স্বাস্থ্যকর্মী।
দায়ী নিম্নমানের আইসিইউ
ডা. ইহতেশামুল হক বলেন, “ডাক্তারদের আক্রান্ত হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, আমাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (আইসিইউ)।”
করোনাভাইরাসের কোনো রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি করা হলে রোগীর নিশ্বাসের মাধ্যমে সেখানে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, “পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে একটি ব্যবস্থা থাকে, যে ব্যবস্থার মাধ্যমে ওই ভাইরাস বাইরে বের করে দেয়া হয়।”
তাঁর মতে, বাংলাদেশে সিএমএইচ ছাড়া কোনো হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে নেগেটিভ প্রেশার ব্যবস্থা নেই, যার মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে থাকা করোনাভাইরাস বাইরে বের করে দেয়া যায়। এ কারণেই সেখানে কর্মরত ডাক্তাররা আক্রান্ত হচ্ছেন।
ইতিমধ্যে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান একজন ডাক্তার করোনাভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছেন জানিয়ে ডা. ইহতেশাম বলেন, “এভাবে চললে, ডাক্তারদের রক্ষা করা না গেলে আমরা ভবিষ্যতে ডাক্তার পাব কোথায়? দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দীর্ঘ মেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
পিপিই’র মানের বিষয়ে ডাক্তারদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, “অনেকেই এমন অভিযোগ করেছেন। তবে একটি বিষয় ভালো করে বোঝা দরকার, সেটি হলো, যেসকল হাসপাতাল শুধুমাত্র করোনাভাইরাসের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সেখানে ডাক্তাররা মারা যাননি বললেই চলে। কারণ এখানে ডাক্তাররা সঠিকভাবে পিপিই ব্যবহার করেছেন।”
এদিকে এত সংখ্যক ডাক্তারের প্রাণহানিতে “ব্যক্তিগতভাবে খুবই চিন্তিত,” মন্তব্য করে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ.ফ.ম. রুহুল হক বেনারকে বলেন, “এভাবে যদি ডাক্তার মারা যেতে থাকেন, আর যদি করোনাভাইরাস সমস্যা দীর্ঘ মেয়াদী হয়, তাহলে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে আসবে।”
তাঁর মতে, “নিম্নমানের পিপিই সরবরাহ এবং সঠিকভাবে পিপিইর ব্যবহারের বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না দেয়ার কারণেই এতো ডাক্তার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন।”
রুহুল হক বলেন, “সঠিক কারণ বের করে ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকবে না।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ৪৫ জন এবং আক্রান্ত হিসবে নতুন করে চিহ্নিত হয়েছেন তিন হাজার ২৪৩ জন।
এ নিয়ে শুক্রবার পর্যন্ত দেশে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার ৫৩৫ জন, আর মারা যাওয়া মোট রোগীর সংখ্যা এক হাজার ৩৮৮।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৮৫ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন চার লাখ ৫৭ হাজারের বেশি।