সিনোফার্মের টিকার দাবিতে ঢাকায় চীনে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

কামরান রেজা চৌধুরী ও জেসমিন পাপড়ি
2021.06.21
ঢাকা
সিনোফার্মের টিকার দাবিতে ঢাকায় চীনে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন চীনের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়ার দাবিতে ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাসের সামনে চীনে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন। মহামারির কারণে দেশে ফিরে আসা এইসব শিক্ষার্থীরা বলছেন, চীনের তৈরি টিকা না পেলে পড়াশোনার জন্য তাঁরা চীন যেতে পারবেন না। ২১ জুন ২০২১।
[বেনারনিউজ]

তৃতীয় টিকা হিসেবে সোমবার থেকে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে ফাইজার-বায়োএনটেকের তৈরি করোনা টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ। একই দিন চীনা টিকা দেবার দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধন করেছেন ওই দেশে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, চীনা টিকা ছাড়া তাঁদেরকে ফিরে যাবার ভিসা দিচ্ছে না দেশটি। বাংলাদেশে ব্যবহৃত চীনের সিনোফার্মের টিকার দাবিতে সোমবার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন চীনে অধ্যয়নরত কয়েকশ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, যারা মহামারি শুরুর পর দেশে এসে আর চীন যেতে পারেননি। 

ভয়েস অব বাংলাদেশি স্টুডেন্টস ইন চায়না নামক সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত ওই মানববন্ধন থেকে বলা হয়, প্রয়োজনীয় টিকা না পেলে তাঁদের শিক্ষাজীবন হুমকির মধ্যে পড়বে।

মানববন্ধনের বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১৯ সালের নভেম্বর করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হলে চীনে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অনেকেই দেশে ফিরে আসেন। এরপর অনলাইনে পাঠদান চললেও অনুপস্থিতির কারণে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ছেন। তাই তাঁদের অচিরেই চীনে যাওয়া প্রয়োজন।

ইতোমধ্যে চীন সরকার দেশটিতে প্রবেশের শর্ত হিসাবে সেদেশে উৎপাদিত ভ্যাক্সিনের কথা উল্লেখ করেছে জানিয়ে মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, চীনে অধ্যয়নরত চার হাজার শিক্ষার্থীর তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এই মুহূর্তে ওই শিক্ষার্থীদের জন্য টিকা বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয়। চীন থেকে বাংলাদেশের কেনা দেড় কোটি টিকার চালান আসতে শুরু করলে তাঁদের টিকা দেয়া হবে।

প্রসঙ্গত, দুই দফায় উপহার হিসেবে চীন থেকে মে ও জুন মাসে বাংলাদেশে আসে মোট ১১ লাখ ডোজ সিনোফার্মের টিকা। টিকাগুলো স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তার ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এখন পর্যন্ত এই টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন প্রায় সাড়ে দশ হাজার জন। 

চীন ফিরতে লাগবে চীনা টিকা

বাংলাদেশের হাতে থাকা চীনা টিকা থেকে শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া সম্ভব বলে বেনারকে জানান মানববন্ধনে অংশ নেয়া চীনের চাংহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মাস্টার্স শ্রেণীর ছাত্র ফজলে রাব্বি।

তিনি বলেন, “চীন যেতে গেলে চীনা উৎপাদিত টিকা নিতে হবে। এই টিকা না পেলে আমরা প্রায় পাঁচ হাজার ছাত্র-ছাত্রী চীনে যেতে পারব না।”

ফজলে রাব্বি জানান, চীনে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। মহামারির কারণে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী দেশে চলে আসার পর কেউ আর ফিরে যেতে পারেননি।

চীন ভিসার জন্য চীন টিকা নিতে হবে এমন কোনো শর্ত দেয়া হয়েছে কি না জানতে চেয়ে ঢাকাস্থ চীন দূতাবাসে বেনারের পক্ষ থেকে ইমেইল পাঠানো হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বেনারকে বলেন, “আমরা চীনে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বলেছি, আমরা তাদের জন্য চীনা টিকা দেবো। কিন্তু এখন নয়। নতুন টিকা অচিরেই আসবে। তখন তাদের দেয়া হবে।”

বর্তমানে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে চীনা টিকা শুধু স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তার, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের দেয়া হচ্ছে জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, “আগে তো ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বাঁচাতে হবে।”

বাংলাদেশে আসা ১১ লাখ চীনা টিকার মধ্যে “বাংলাদেশে অবস্থানরত ১৫ হাজার চীনা নাগরিকের জন্য ৩০ হাজার ডোজ নির্ধারণ করা আছে,” বলে জানান মহাপরিচালক আবুল বাশার। ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধেক চীনা নাগরিক টিকা গ্রহণ করেছেন বলেও জানান তিনি। 

করোনার তৃতীয় টিকার প্রয়োগ শুরু

যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির ফাইজার-বায়োএনটেকের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে সোমবার। বাংলাদেশে ব্যবহৃত এটি করোনাভাইরাসের তৃতীয় টিকা। এর আগে থেকে বাংলাদেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্র্যাজেনেকা ও সিনোফার্ম'র টিকা দেয়া হচ্ছে। 

সোমবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৩৬০ জনকে এই ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা দেওয়ার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকাদান কার্যক্রম পরিদর্শনের সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সাংবাদিকদের জানান, আগামী ১০ দিন এই টিকাদান কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হবে। টিকা গ্রহণকারীদের কোনো ধরনের সমস্যা না পেলে পরবর্তীতে আরও বেশি মানুষের ওপর এই টিকা প্রয়োগ করা হবে।

গত ৩১ মে কোভ্যাক্স প্রকল্পের আওতায় এক লাখ ছয় হাজার ডোজ ফাইজারের টিকা পায় বাংলাদেশ। এই টিকাটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়, যা ঢাকার বাইরে নিশ্চিত করা কঠিন। তাই আপাতত শুধু ঢাকাতেই এটির প্রয়োগ করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

যারা নিবন্ধন করেও টিকা পাননি তাঁদের কাছে ফাইজারের টিকা দেওয়া শুরুর ঘটনাটি “সুখবর” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ড. মোহাম্মদ মুশতাক হোসেন।

ভারত থেকে কেনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্র্যাজেনেকার করোনার টিকার মাধ্যমে গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে গণ টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। কিন্তু টিকার সংকটের কারণে গত ২৬ এপ্রিল প্রথম ডোজ টিকাদান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। বর্তমানে স্বল্প মাত্রায় টিকাটির দ্বিতীয় ডোজের প্রয়োগ চালু রয়েছে।

চুক্তি অনুযায়ী ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে জুন মাসের মধ্যে মোট তিন কোটি টিকা আসার কথা থাকলেও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭০ টিকা আসার পর আর কোনো টিকা পায়নি বাংলাদেশ। এর বাইরে ভারত সরকারের উপহার হিসেবে তিন দফায় বাংলাদেশ পেয়েছে ৩৩ লাখ ডোজ টিকা। 

করোনার ‘তৃতীয় ঢেউ’

গত এক দিনে দেশে নতুন করে ৪ হাজার ৬৩৬ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে এবং ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে সোমবার জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

দেশে আবারও করোনার সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতিকে করোনার তৃতীয় ঢেউ বলছেন বিশ্লেষকেরা।

ডা. মুশতাক হোসেন বেনারকে বলেন, “এটা করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে পরিণত হচ্ছে। কারণ, প্রথম ঢেউয়ের উচ্চতা ছিল প্রতিদিন চার হাজারের উপরে শনাক্ত হওয়া। আমরা সেদিকেই যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে।”

তাঁর মতে এখনই “গোটা দেশেই যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। কারণ সামনে ঈদুল আজহা উপলক্ষে মানুষের যাতায়াত বাড়বে। এখন থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ভারসাম্য থাকবে।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে এখন পর্যন্ত ৮ লাখ ৫৬ হাজার ৩০৪ জন করোনা শনাক্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ১৩ হাজার ৬২৬ জন। 

সাত জেলায় লক ডাউন

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে ঢাকা বিভাগের সাত জেলায় মঙ্গলবার থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত নয় দিনের জন্য জরুরি পরিষেবা ছাড়া সব ধরনের কার্যক্রম ও চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার।

জেলাগুলো হলো; মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জ। সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক আদেশে এই নির্দেশনা জারি করা হয়।

“এসব জেলায় শুধুমাত্র মালবাহী ট্রাক এবং অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া কিছু চলবে না। জেলাগুলো ব্লকড থাকবে, কেউ ঢুকতে পারবে না,” সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।

সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে সাতক্ষীরা, বাগেরহাটের মোংলা, যশোর পৌরসভা, অভয়নগর, বেনাপোল, শার্শা, কুষ্টিয়া সদর, চুয়াডাঙ্গা দামুরহুদা, মাগুরা, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন, নাটোর পৌরসভা ও সিংড়া এবং বগুড়া পৌরসভায় একই ধরনের বিধিনিষেধ চলছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।