করোনাভাইরাস: শতাধিক মৃত্যু, সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণা

পুলক ঘটক
2021.06.25
ঢাকা
করোনাভাইরাস: শতাধিক মৃত্যু, সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আকস্মিক বেড়ে যাওয়ায় লকডাউন দেওয়া হতে পারে, এমন আশঙ্কায় গত কয়েকদিন ধরে মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় মাইক্রোবাসে দূর পথে রওনা হচ্ছেন যাত্রীরা। ২৫ জুন ২০২১।
[ফোকাস বাংলা]

করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা একশ’ পার হওয়ার দিনই পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সোমবার থেকে সারা দেশে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার।

এসময় লকডাউন নিশ্চিত করতে এবং মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করার জন্য পুলিশ এবং বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। 

তথ্য অধিদপ্তরের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা সুরথ কুমার সরকার স্বাক্ষরিত গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শুক্রবার রাতে সরকার লকডাউন জারির ঘোষণা দেয়। লকডাউন চলাকালে জরুরি পরিষেবা ছাড়া সব সরকারি–বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। জরুরি পণ্যবাহী ছাড়া সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। শুধু অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত যানবাহন চলাচল করতে পারবে।

এসময় জরুরি কারণ ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে বের হতে পারবেন না জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “গণমাধ্যম এর আওতা বহির্ভূত থাকবে।” 

এর আগে ৩০ জুন পর্যন্ত সাতটি জেলায় কঠোর লকডাউন দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। 

কত দিনের জন্য এই লকডাউন থাকবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন বলেন,  "প্রথমে ২৮ জুন থেকে এক সপ্তাহের জন্য এটা বলবত করা হবে। এরপর পরিস্থিতি অনুযায়ী তা আরও বাড়ানো হবে।” 

“মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কাজ করবে পুলিশ, বিজিবি। তাদের সমর্থন দেওয়ার জন্য মোতায়েন থাকবে সেনাবাহিনী,” বলেন মন্ত্রী। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ১০৮ জন। এর আগে এই রোগে গত ১৯ এপ্রিল একদিনে সর্বোচ্চ ১১২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। দেশে এ পর্যন্ত করোনায় মোট মারা গেছেন ১৩ হাজার ৯৭৬ জন।

একই সময়ে নতুন করে আরও ৫ হাজার ৮৬৯ জনের শরীরে ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে দেশে মোট আট লাখ ৭৮ হাজার ৮০৪ জন করোনা রোগী শনাক্ত হলেন। 

করোনার ডেল্টা ধরন: সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি

চলতি বছর করোনা সংক্রমণ বাড়ায় গত ৫ এপ্রিল থেকে কয়েক দফায় শিথিল লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। গত ২৪ মে থেকে গণপরিবহন চলার অনুমতি দেয়া হয়।

কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় দেশের সাতটি জেলায় পূর্ণাঙ্গ লকডাউন ও ঢাকার সঙ্গে যান ও জনচলাচল বন্ধ করার নির্দেশনা দেয়া হয়।

এমতাবস্থায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে আশঙ্কায় বৃহস্পতিবার করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সারাদেশে ১৪ দিনের পূর্ণ “শাটডাউনের সুপারিশ” করেছিল।

“সরকারি ঘোষণায় শাটডাউন শব্দটি না থাকলেও পরামর্শক কমিটির সুপারিশই অনুসরণ করা হচ্ছে,” বেনারকে বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

বৃহস্পতিবার জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ’র সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “কোভিড-১৯ এর বিশেষ ডেল্টা প্রজাতির সামাজিক সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে এবং দেশে ইতিমধ্যে করোনার প্রকোপ অনেক বেড়েছে। এই প্রজাতির জীবাণুর সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। রোগ প্রতিরোধের জন্য খণ্ড খণ্ড ভাবে নেওয়া কর্মসূচির উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।” 

২৫ লাখ টিকা আসছে

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, করোনা টিকার বৈশ্বিক উদ্যোগ ‘কোভ্যাক্স’ থেকে আগামী সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে থেকে ২৫ লাখ ডোজ মডার্নার টিকা পাওয়া যাবে।

“কোভ্যাক্স আমাদেরকে পর্যায়ক্রমে প্রায় ৭ কোটি ডোজ টিকা দিতে চেয়েছিল। আজকে আমারা চিঠি পেয়েছি, তারা আগামী সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে আমাদেরকে ২৫ লাখ ডোজ মর্ডানার টিকা নিতে বলেছে,” বেনারকে বলেন মন্ত্রী।

“চীনের টিকার জন্য এর আগে চুক্তি হয়েছে। আশা করছি আগামী কিছু দিনের মধ্যে তারা একটা লট দেবে। তবে কখন দেবে ওরা কত ডোজ দিবে সেটা পরে জানিয়ে দেবে,” বলেন তিনি। 

গার্মেন্টস খোলা রাখার দাবি

লকডাউন সফল করার জন্য সোমবার থেকে সারাদেশে শপিংমল এবং দোকানপাট বন্ধ রাখা হবে বলে বেনারকে বলেছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন।

“কাঁচাবাজার এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকানের বিষয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে সেভাবে হবে। বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে এটা মানতে হবে। তবে সকল মানুষ যদি অবস্থাটা বুঝত এবং মাস্ক পরত তাহলে হয়তো সরকারকে এরকম পদক্ষেপ নিতে হতো না,” বলেন তিনি।

তবে এমন পরিস্থিতিতেও পোশাক কারখানাগুলো খোলা রাখতে চান মালিকরা। গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান বেনারকে বলেছেন, “কারখানা বন্ধ হলে অনেক অর্ডার বাতিল হবে, ক্রেতারা আমাদের হাতছাড়া হবে হয়ে যাবে।” 

“পোশাক কারখানাগুলো লকডাউনের বাইরে রাখা উচিত। এতে লকডাউনের উদ্দেশ্য সফল হবে। তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ করলে লাখ লাখ গার্মেন্টস কর্মী গ্রামে যাওয়ার চেষ্টা করবে। তাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে এবং করোনা আরও ছড়িয়ে পড়ার ভয় আছে,” বলেন তিনি। 

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটির সদস্য ও ভাইরোলজিস্ট ড. নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “এই লক ডাউন যদি আগের মতোই হয় তাহলে আসলেই এটা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। আর যদি কঠোরভাবেও মানা হয় তবে সাত দিনের পরিবর্তে এটা অন্তত ১৪ দিনের হওয়া উচিত।”

“কারণ, ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪ দিনের। একজন মানুষের শরীরে যদি ভাইরাস প্রবেশ করে তাহলে তাঁকে আইসোলেশনে বা প্রয়োজনে হাসপাতালে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সাত দিন পর যদি সব খুলে দেওয়া হয়, তাহলে ভাইরাস নিয়েই তিনি আবার বাইরে যাবেন এবং সংক্রমণ বাড়াবেন,” যোগ করেন তিনি। 

তবে লক ডাউন নয় মূলত শতভাগ মানুষের মাস্ক পরা নিশ্চিত না করা গেলে কোনোভাবেই করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে মনে করেন ড. নজরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করে সকলের মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। শতভাগ মাস্ক পরা নিশ্চিত করা গেলে তখন সবকিছু খুলে দিয়েও করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।” 

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।