করোনাভাইরাস মোকাবেলা: নার্স সংকট, আক্রান্ত অনেকেই

শরীফ খিয়াম
2020.06.29
ঢাকা
200629_COVID_nurses_1000.jpeg ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনাভাইরাস ইউনিটে এক রোগীর শুশ্রূষা করছেন একজন নার্স। ১৩ মে ২০২০।
[সৌজন্যে: সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটস]

চার মাস ধরে ক্রমাগত বেড়ে চলা করোনাভাইরাস রোগীদের সেবার পাশাপাশি নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন দেশের অর্ধ লক্ষাধিক নার্স।

সোমবার পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজার ৫৬৫ জন নার্স করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটসের (এসএনএসআর) মহাসচিব সাব্বির মাহমুদ তিহান।

“আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন সাড়ে সাতশ এবং ছয়জন মারা গেছেন। এ ছাড়া উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও দুইজন,” বলেন সাব্বির।

সংগঠনটির হিসেবে, সংক্রমণের শিকার হওয়া নার্সদের মধ্যে এক হাজার ২৯৩ জন সরকারি ১২০টি হাসপাতালে এবং বাকি ২৭২ জন বেসরকারি ৩৪টি হাসপাতালে কর্মরত।

বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের সর্বশেষ (৩১ মে) হিসাব অনুযায়ী, দেশে ৬৬ হাজার ৯৫৮ জন ডিপ্লোমা বা গ্রাজুয়েট নিবন্ধিত নার্স রয়েছেন। ধাত্রী এবং ছয় থেকে ২৭ মাস মেয়াদী বিভিন্ন কোর্স করা নিবন্ধিত স্বাস্থ্যকর্মীসহ হিসেব করলেও সংখ্যাটা এক লাখ ২২ হাজারের কিছু বেশি।

অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী দেশে কমপক্ষে আড়াই লাখ নার্স দরকার বলে জানান এসএনএসআর মহাসচিব। তিনি বলেন, “আমাদের নার্সদের ৯০ শতাংশই নারী। গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার নার্স সব সময় মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকেন।”

সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে ৫৫ হাজার নার্স কোভিড যুদ্ধে সক্রিয় আছেন জানিয়ে সাব্বির বলেন, “মহামারি পরিস্থিতির কারণে নার্সের সংকট এখন বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে।”

চলতি মাসেই নার্স হিসেবে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে যোগ দিয়েছেন হাফসা আক্তার।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ তথা সারা দুনিয়া থেকে এই মহামারি একদিন শেষ হয়ে যাবে। বেঁচে থাকলে সেদিন সবাইকে মাথা উঁচু করে বলব আমিও ছিলাম একজন কোভিড যোদ্ধা। আর মরে গেলেও বীরের মতো মরব।”

নার্সরা যাতে দৈহিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থেকে রোগীদের সেবা করতে পারেন সেজন্য প্রতিটি হাসপাতালকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং নার্সিং ও মিডওয়াইফ অধিদপ্তরের গাইডলাইন অনুসরণ করতে হবে বলে দাবি জানান নার্স নেতা সাব্বির।

চার হাজার নার্স নিয়োগ পাচ্ছেন

গত মাসে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে সাময়িকভাবে পাঁচ হাজার ৫৪ জন নার্স নিয়োগ দিয়েছে সরকার। সর্বশেষ সোমবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা আরও চার হাজার নার্স নিয়োগ দিচ্ছি। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছি।”

তবে এসএনএসআর নেতা সাব্বির বলেন, “এতেও ঘাটতি পূরণ হবে না। এই মুহূর্তে ৫০ হাজার নার্স নিয়োগ করেও সংকট দূর করা সম্ভব নয়।”

“ডব্লিউএইচওর নীতিমালা অনুযায়ী, কারো দুগ্ধপোষ্য শিশু থাকলে তাঁদের সরাসরি কোভিড ওয়ার্ডে ডিউটি দেওয়া যাবে না,” জানিয়ে সাব্বির বলেন, “কিন্তু বাংলাদেশে নার্সের সংখ্যা এতটাই কম যে, অনেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁদেরও কোভিডের ডিউটি দিতে বাধ্য হচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।

তবে এ ব্যাপারে ভিন্ন বক্তব্যও পাওয়া গেছে। ঢামেক হাসপাতালের বিএনএ নেতা মোহাম্মদ কামাল হোসেন পাটোয়ারীর দাবি সেখানে দুই হাজার চারশ নার্স রয়েছেন, কোনো সংকট নেই। এছাড়া গর্ভবতী নার্সদের কোভিড ইউনিটে কাজ দেওয়া হচ্ছে না বলেও দাবি করেন তিনি।

যদিও সাব্বিরের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে আক্রান্তদের মধ্যে গর্ভবতী ১০ জন এবং শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো অর্ধশতাধিক নার্স রয়েছেন।

 

 

অব্যবস্থাপনার অভিযোগ

থাকা-খাওয়া নিয়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে এসএনএসআর মহাসচিব জানান, এই কোভিড যোদ্ধাদের সঙ্গনিরোধের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না।

“সঙ্গনিরোধের মূলনীতি হচ্ছে প্রত্যেক রুমে একজন করে থাকবে। কিন্তু ঢাকার বাইরে একটি কক্ষে দুই-তিনজন করে নার্স রাখা হয়েছে এবং অনেক জায়গায় পরিত্যক্ত ভবনেও নার্সদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছু জায়গায় বিছানাও দেওয়া হয়নি, মেঝেতে থাকার খবর পেয়েছি,” বলেন সাব্বির।

রাজধানীতে কর্মরতরা তুলনামূলকভাবে ভালো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এই নার্সিং কর্মকর্তা বলেন, “খাবারের জন্য প্রতিদিন মাথাপিছু পাঁচশ টাকা বরাদ্দ থাকলেও অনেক জায়গায় খুবই নিম্নমানের খাবার দেওয়া হচ্ছে।”

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে একাধিক চিঠি দিয়ে বিষয়গুলো জানিয়েছে এসএনএসআর। যদিও মন্ত্রণালয়ের নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অনুবিভাগ প্রধান মোহাম্মদ শাহাদত হোসেন বেনারকে বলেন, “নার্সদের পক্ষ থেকে এখনো বড় ধরনের কোনও অভিযোগ আসেনি।”

“কোভিড যোদ্ধাদের স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা এবং থাকা-খাওয়ার বিষয়গুলো সার্বক্ষণিক নজরে রাখছেন কর্মকর্তারা,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশ নার্সেস এসোসিয়েশনের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাখার সভাপতি মোহাম্মদ কামাল হোসেন পাটোয়ারী বেনারকে বলেন, “শুরুতে পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী) সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা থাকলেও বর্তমানে সার্বিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক।”

নমুনা পরীক্ষায় টাকা লাগবে
করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য ফি আরোপ করেছে সরকার। এখন থেকে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত বুথে গিয়ে নমুনা দিয়ে পরীক্ষা করানোর জন্য দিতে হবে ২০০ টাকা। হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের নমুনা পরীক্ষার জন্যও লাগবে একই পরিমাণ টাকা।
সোমবার এ–সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করেছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।

এতে বলা হয়, বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করাতে চাইলে রোগীকে দিতে হবে ৫০০ টাকা।

এত দিন সরকারিভাবে করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা বিনামূল্যে করা হচ্ছিল। তবে বেসরকারি হাসপাতালে আগে থেকেই পরীক্ষার জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা দিতে হতো। আর বেসরকারিভাবে বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য রোগীকে দিতে হয়েছে সাড়ে চার হাজার টাকা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তারের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত চার হাজার ১৪ জনসহ এ পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ ৪১ হাজার ৮০১।

গত ২৪ ঘন্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪৫ জন। এ নিয়ে করোনাভাইরাসে দেশে মোট মারা গেছেন এক হাজার ৭৮৩ জন।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট এক কোটি এক লাখ ৯৫ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন পাঁচ লাখ দুই হাজারের বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা অব্যাহত থাকবে

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সহায়তা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে জানায়, ওই দিন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে আলাপকালে এই কথা জানান।

বিবৃতিতে বলা হয়, আলাপকালে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ পর্যন্ত করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশকে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩ মিলিয়ন ডলার সহায়তার বিষয়টিও পুনরালোচনা করেন।

এছাড়া, বৈশ্বিকভাবে করোনাভাইরাস সংকটে জরুরি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথাও আলোচনা করেন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

“স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও সম্মানের সাথে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বার্মায় (মিয়ানমার) প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়টিও দুই নেতা পুনর্ব্যাক্ত করেন,” বলা হয় বিবৃতিতে।

প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তায় এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৮২ কোটি ডলার সহায়া করেছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।