করোনাভাইরাস: বিমানবন্দর থেকেই ১৬৮ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠালো ইতালি
2020.07.08
ঢাকা

বাংলাদেশ থেকে সকল ফ্লাইট নিষিদ্ধ ঘোষণার একদিন পরেই দুটি বিমানবন্দর থেকে ১৬৮ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠালো ইতালি।
রোমে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) মো. আরফানুল হক বেনারকে জানান, “দুটি ভিন্ন ফ্লাইটে ঢাকা থেকে দোহা হয়ে ১৮৩ জন বাংলাদেশি বুধবার ভোরে ইতালি যান। এদের মধ্যে মোট ১৬৮ জন বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীকে দোহাগামী দুইটি ফ্লাইটে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।”
তিনি জানান, এদের মধ্যে ১২৪ জনকে রোমের ফিউমিসিনো লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি বিমানবন্দর থেকে এবং ৪৪ জনকে মিলানের মালপেনসা বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, “রোমে পৌঁছানো বাংলাদেশিদের মধ্যে একজন ছিলেন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারী। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে রোমে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।”
এছাড়া মিলানে পৌঁছানো বাংলাদেশিদের মধ্যে ১৪ ইতালিয় পাসপোর্টধারী ছিলেন, ফলে তাঁদেরকেও ইতালি প্রবেশ করতে দেয়া হয় বলে জানান আরফানুল হক।
দূতাবাসের পক্ষ থেকে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে শর্তসাপেক্ষে যাত্রীদের ইতালি প্রবেশ করতে দেয়ার অনুরোধ জানানো হলেও বাকিদের বিমান থেকেই নামতে দেওয়া হয়নি বলে জানান আরফানুল হক।
তবে ফ্লাইট দুটির অন্য যাত্রীদের ইতালি প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ফেরত পাঠানো বাংলাদেশিরা কাতার হয়ে ঢাকায় ফিরবেন বলে জানান তিনি।
এর আগে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কয়েকজন যাত্রীর দেহে করোনাভাইরাস শনাক্তের পর বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সব ফ্লাইট মঙ্গলবার নিষিদ্ধ করে ইতালির সরকার।
মঙ্গলবার দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি বলা হয়, “আগামি এক সপ্তাহের সাময়িক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ইতালি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও শেনজেন অঞ্চলের বাইরে থেকে আসা যাত্রীদের জন্য নতুন করে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে কাজ করবে।”
এদিকে করোনাভাইরাস সম্পর্কিত সত্য গোপন রাখায় বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
বুধবার সরকারি বাসভবনে নিয়মিত ব্রিফিং এ তিনি বলেন, “কেউ কেউ করোনা নেগেটিভ সনদ নিয়ে বিদেশে গিয়ে বিমানবন্দরে পজিটিভ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এটি লাখ লাখ প্রবাসীকে অবিশ্বাস ও আর অনিশ্চয়তার আঁধারে ঠেলে দিচ্ছে।”
“যাঁরা এই কাজ করছেন তাঁরা নিজেরাই নিজেদের বিপদে ঠেলে দিচ্ছেন,” বলেন ওবায়দুল কাদের।
ঢাকায় হাসপাতাল সিলগালা, মামলা
সরকারের সাথে করা চুক্তি ভঙ্গ করে করোনা রোগীদের থেকে বিল আদায়, পরীক্ষা না করেই ভুয়া প্রতিবেদন তৈরিসহ নানা অভিযোগে রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতালের দুটি শাখা সিলগালা করে দিয়েছে র্যাব।
এসব অভিযোগে চেয়ারম্যান মো. সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে। এদের মধ্যে আটজনকে আটক করা হয়েছে, সাহেদসহ বাকি নয়জন পলাতক।
বুধবার আটক সাতজনকে পাঁচ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
বুধবার দুপুরে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম সাংবাদিকদের বলেন, “রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে ধরতে অভিযান চলছে।”
বুধবার অভিযানকালে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, রিজেন্ট হাসপাতালটি (মিরপুর শাখা) করোনা রোগীদের রক্তের স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা না করে ফেলে দিত। অথচ প্রতিটি পরীক্ষার জন্য ৩৫০০ টাকা করে রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া হতো।”
তাছাড়া ২০১৭ সালে হাসপাতালটির অনুমতির মেয়াদ শেষ হলেও তা আর নবায়ন করেনি বলে জানান তিনি। সোমবার হাসপাতালটির উত্তরা শাখায় অভিযানকালেও একই অভিযোগ করেন সারোয়ার আলম।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “হাসপাতালটির ভুয়া করোনা রিপোর্ট করত- এমন ১৪টি অভিযোগ র্যাবের কাছে জমা পড়ার প্রেক্ষিতেই অভিযান চালানো হয়।”
“সরকারের সাথে হাসপাতালের চুক্তি অনুযায়ী, রিজেন্ট বিনামূল্যে কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দেবে। যে ব্যয় সরকার বহন করবে। কিন্তু রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষণ প্রায় প্রত্যেক রোগীর কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা আদায় করেছে,” বলেন তিনি।
“আবার বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে উল্লেখ করে সরকারের কাছে ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকার বেশি বিলও জমা দিয়েছে হাসপাতালটি,” বলছিলেন র্যাবের এই ম্যাজিস্ট্রেট।
র্যাবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত প্রায় দুইশ কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল। পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষা না করেই আরও তিন গুণ লোকের ভুয়া করোনা প্রতিবেদন দিয়েছে তারা।
‘সরকারি উদ্যোগে পরীক্ষা করা উচিত’
দীর্ঘদিন ইউরোপের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ থাকার পর সদ্য আবার চলাচল শুরু হয়। এর মাঝে গত ৬ জুলাই বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ২২৫ জন যাত্রীর মধ্যে অন্তত ৩৭ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় বলে বুধবার এক প্রতিবেদনে জানায় বার্তাসংস্থা এপি।
এ প্রসঙ্গে বিমান এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন বেনারকে বলেন, বিমান যে নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, সেখানে কোভিড-১৯ পজিটিভ না নেগেটিভ সে সম্পর্কিত সনদ থাকার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
“আন্তর্জাতিক বা আভ্যন্তরীণ কোনো ফ্লাইটের ক্ষেত্রেই সনদ জরুরি নয়, বাধ্যতামূলকও নয়। বিমানবন্দরে যাত্রীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়, আবার বিমানে ওঠার আগেও করা হয়,” তিনি বলেন।
সে ক্ষেত্রে তাঁদের দিক থেকে কোনো গাফিলতি আছে বলে মনে করেন না মোকাব্বির হোসেন।
তবে অনেকেই মনে করেন প্রবাসী শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এর আগে বাংলাদেশ থেকে জাপানে চার্টার্ড ফ্লাইট চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটির কর্তৃপক্ষ।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক শহীদুল হক বেনারকে বলেন, “টোকিওর পর ইতালিতে বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত ফ্লাইট বন্ধ হলো। এটা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। অভিবাসী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সরকারের উচিত উদ্যোগ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা। নিশ্চিত হয়ে তবেই বিদেশে পাঠানো।”
“অভিবাসী শ্রমিকরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কি না, সেটা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে পরীক্ষা করানো দরকার,” বলেন তিনি।
এর আগে গত ২২ জুন নিষেধাজ্ঞা আসে বাংলাদেশ থেকে চীনের গুয়াংজুগামী ফ্লাইটের ক্ষেত্রেও। জুনের তৃতীয় সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়া বেশ কিছু দেশের বিমানের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
বিপাকে প্রবাসীরা
চলমান পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছেন ইতালিতে বসবাসরত বাংলাদেশীরা। রোমে ভ্রমণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মো ইউসুফ বেনারকে বলেন, তাঁরা বেশ লজ্জায় পড়ে গেছেন। পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে, মিথ্যে সব রিপোর্ট হাতে করে বাংলাদেশিরা ইতালিতে আসছেন।
“বাংলাদেশিদের করোনা পরীক্ষায় রাজধানী রোমে একাধিক বুথ খোলা হয়েছে,” জানিয়ে ইউসুফ বলেন, তাঁরা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিতেও আছেন।
আগামী ২৪ জুলাই ইতালিতে ফিরে যাওয়ার কথা শরিয়তপুরের নড়িয়ার বাচ্চু শেখের। তিনি পাঁচ মাস ধরে দেশে আছেন জানিয়ে বেনারকে বলেন, “কারখানা মালিক খবর দিয়েছেন।”
“কিন্তু পরীক্ষা করিয়ে যাব, না কি পরীক্ষা করাতে হবে না সে বিষয়ে পরিষ্কারভাবে কেউ কিছু বলে না। ফ্লাইট চলবে না বাতিল হবে তাও জানি না,” বলেন বাচ্চু শেখ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে বুধবার বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ৪৪ জন, আক্রান্ত হিসেবে নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৪৮৯ জন।
এ নিয়ে এখন পর্যন্ত দেশে মোট করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭২ হাজার ১৩৪ জন। এখন পর্যন্ত এই রোগে মারা গেছেন দুই হাজার ১৯৭ জন।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট এক কোটি ১৯ লাখ ২১ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন পাঁচ লাখ ৪৫ হাজারের বেশি।