করোনাভাইরাস: মারাত্মক মানসিক চাপে স্বাস্থ্যকর্মীরা
2021.08.04
ঢাকা

করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে বাংলাদেশে চিকিৎসা পেশার সাথে জড়িতরা ‘ভয়াবহ মাত্রায়’ মানসিক সমস্যা ভুগছেন জানিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগের দাবি জানালেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, এ সংক্রান্ত “একটি গাইডলাইন” ছাড়া সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
মহামারিকালে রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি উঠে এসেছে সাম্প্রতিক দুটি গবেষণাতেও।
গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা দুশ্চিন্তা ও হতাশায় ভুগছেন, তাঁদের কেউ কেউ পেশা পরিবর্তনের কথাও ভাবছেন।
গত বছরের জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ৮০৩ জন স্বাস্থ্যকর্মীর জরিপ চালিয়ে গত ২৫ মে গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের একদল গবেষক।
১৮ বছর থেকে ৫৮ বছর বয়সীদের ওপর পরিচালিত ওই গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৪১ ভাগের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী মারাত্মক দুশ্চিন্তা এবং প্রায় ১৬ ভাগ ভুগছেন উচ্চমাত্রায় হতাশায়।
এ ছাড়া এই স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি মাত্রায় দুশ্চিন্তায় ভুগছেন প্রায় ৭০ ভাগ এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় হতাশায় ভুগছেন প্রায় ৪০ ভাগ।
অপরদিকে গত বছরের ২২ নভেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনাভাইরাস চিকিৎসার সাথে যুক্ত ৫৪৭ জন নার্সের ওপর একটি গবেষণা করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ বিভাগের একদল গবেষক। এই গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয় গত ২ এপ্রিল।
এতে দেখা গেছে, গবেষণায় অংশ নেয়া নার্সদের অর্ধেকের বেশি ভুগছেন উচ্চমাত্রার হতাশায়।
সরকারি উদ্যোগের দাবি
চিকিৎসক ও নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্য বিবেচনায় নিয়ে এই সমস্যা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীদের বিভিন্ন সংগঠন ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা
সংশ্লিষ্টদের মতে, নিরলসভাবে সেবা দেয়া, পরিবার সদস্যদের আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যু এবং যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়ার ঘটনাগুলো স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর ভয়াবহ মানসিক চাপ তৈরি করছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্যমতে, দেশে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৭৮জন চিকিৎসক এবং ৪২জন নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন কয়েক হাজার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী।
গত মাসের শুরুর দিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসক ডা. জাকি উদ্দিনের বাবা। তার ছয় মাস আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান এই চিকিৎসকের মা।
মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে মা-বাবাকে হারিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাসে দিয়ে মা-বাবাকে করোনায় আক্রান্ত করার জন্য তিনি নিজেকে দায়ী করে প্রশ্ন রাখেন- এরপরও কি এই পেশায় তাঁর থাকা উচিত?
গত বছরের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে প্রথমদিকে যে কয়টি হাসপাতালকে কোভিড-ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করা হয় তার একটি মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। রাজধানীর এই হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটে মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ডা. মো: তানভীর আহমেদ।
গত বছরের জুন মাসে পুরো পরিবার নিয়ে করোনায় আক্রান্ত হন ডা. তানভীর। এসময় তিনি তাঁর ৫৬ বছর বয়সী বাবাকে হারান।
“এটা সত্যিই কষ্টের। ভীষণ রকম কষ্টের। আমি আমার বাবাকে হারিয়েছে এই মুগদা হাসপাতালেই। এখানে আমি এখনও দায়িত্ব পালন করছি। প্রতিদিনই কমপক্ষে চারজন রোগীর মৃত্যু সনদে আমাকে সই করতে হয়। এটা দিনের পর দিন নেয়া যায় না,” বেনারকে বলেন ডা. তানভীর।
“ডাক্তাররাও মানুষ, তাদের সামনে প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে। তারা কোনো রকম বিশ্রাম পাচ্ছেন না। এভাবে দিনের পর দিন সেবা দেয়া কঠিন,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বিএমএ’র মহাসচিব ডা. মোঃ ইহতেশামুল হক চৌধুরী।
“বর্তমানে চিকিৎসা পেশার সঙ্গে জড়িতরা ভয়াবহ মাত্রায় মানসিক সমস্যায় ভুগছেন,” জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার শুরুর দিকে চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য আবাসিক হোটেলে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করলেও এখন আর সেই ব্যবস্থাটি নেই।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় আবারো কোয়ারেন্টাইন চালু করার দাবি জানান তিনি।
চিকিৎসকদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা না হলে “করোনাকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থানয় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে,” বলে বেনারকে জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব।
বাংলাদেশ ডক্টরস ফোরামের (বিডিএফ) প্রধান সমন্বয়ক ডা. নিরূপম দাশ বেনারকে বলেন, চিকিৎসকেরা প্রয়োজনীয় প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। করোনায় মারা গেছেন এমন চিকিৎসকদের পরিবারগুলোও যথাযথ আর্থিক প্রণোদনা পাচ্ছেন না।
“এভাবে স্বল্পতম সুবিধা নিয়ে নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে যাওয়া চিকিৎসকদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে,” বলেন এই চিকিৎসক সংগঠক।
চিকিৎসক ও নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সরকারের একটি প্রকল্প নেওয়া উচিত বলে মত দেন সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি এন্ড রাইটসের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির মাহমুদ তিহান।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ থাকলেও বাংলাদেশে বিষয়টি একেবারেই নতুন বলে বেনারকে জানান জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ বিভাগের শিক্ষক শাহাদাত হোসেন।
তিনি বলেন, “সরকারের উচিত বর্তমান পরিস্থিতিতে চিকিৎসকসহ সন্মুখসারির অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য কমপক্ষে নিয়মিত ভার্চুয়াল কনসালটেশনের ব্যবস্থা করা।”
‘একটি গাইডলাইন’ ছাড়া কিছু নেই
চিকিৎসকদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে “একটি গাইডলাইন” ছাড়া সরকারের “তেমন কোনো কাজ নেই এবং বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগও নেই,” বলে বেনারকে জানান অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন।
অধিক সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দিয়ে বর্তমানে কর্মরতদের ওপর থেকে চাপ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “এটা সত্য যে আমাদের ডাক্তার-নার্সরা যে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন তাতে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য অত্যন্ত ভয়াবহ অবস্থায় আছে।”
প্রণোদনা বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাদের দেশে স্বাস্থ্যকর্মীরা সেই অর্থে প্রশংসিত হচ্ছে না। বঞ্চিত হচ্ছেন প্রাপ্য প্রণোদনা থেকেও। এ বিষয়গুলো সমাধানের চেষ্টা করছে অধিদপ্তর।”
তবে ব্যয় সংকোচন ও আরো কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেটি আবারো চালু করার বিষয়ে সরকারের আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই।
বাংলাদেশে প্রথম করোনারোগী শনাক্ত হন গত বছরের ৮ মার্চ, প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ লাখ, নয় হাজার ৯১০ জন, মৃত্যু হয়েছে ২১ হাজার ৬৬৩ জনের।