করোনা মোকাবেলার মাস্ক কেলেঙ্কারি: সরবরাহকারী গ্রেপ্তার

শরীফ খিয়াম
2020.09.29
ঢাকা
200929_ACC_JMI_1000.jpg সরকারের সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর ডিপোতে নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় আটক জেএমআই গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রাজ্জাককে ঢাকার আদালত থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০।
[বেনারনিউজ]

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ভুয়া ‘এন-৯৫ মাস্ক’ সরবরাহের অভিযোগে জেএমআই গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

প্রায় সাড়ে তিন মাস অনুসন্ধানের পর মঙ্গলবার সকালে মামলা দায়ের করা হয় তাঁর বিরুদ্ধে, এরপর দুপুরেই তাঁকে সেগুনবাগিচা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে বেনারকে জানান দুদকের পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য।

গ্রেপ্তারের পর রাজ্জাককে মহানগর দায়রা আদালতে হাজির করলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁর পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয় বলে বেনারকে জানান দুদকের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা মো. জুলফিকার।

মামলার প্রথম ছয় আসামির মধ্যে পাঁচজন স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত থাকা সত্ত্বেও তাঁদের আটক না করার কারণ জানতে চাইলে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার সাংবাদিকদের বলেন, “তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হয়তো এমন কোনো তথ্য এসেছে, যে কারণে শুধু তাঁকেই (রাজ্জাক) গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন ছিল।”

তবে এক্ষেত্রে দুদকের নিরপেক্ষতা, সৎ সাহস ও দৃঢ়তার ঘাটতি ফুটে উঠেছে দাবি করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “এটা হতাশাব্যঞ্জক।”

“বিশেষ করে যারা উচ্চপদে আছেন বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, তাঁদের অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে দুদক বরাবরই নিজেদের তৈরি করা নিজস্ব একটা নিয়ন্ত্রণ রেখা বজায় রেখে চলে,” বলেন এই পর্যবেক্ষক।

তবে প্রয়োজন হলে মাস্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িত সরকারি কর্মকর্তাদের অবশ্যই গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানান দুদক সচিব। তাঁরা প্রত্যেকেই ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন’ বলেও প্রেস ব্রিফিংয়ে উল্লেখ করেন তিনি।

এদিকে করোনাভাইরাসের সাথে যারা সম্মুখ যুদ্ধ করছেন, তাঁদের সুরক্ষা সামগ্রীর মান নিয়ে কোনো আপোষের সুযোগ নেই বলে বেনারকে জানান চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন।

তাঁর মতে “একজন নকল মাস্ক সরবরাহকারী যেহেতু গ্রেপ্তার হয়েছে, একে একে অন্যদের নামও বেরিয়ে আসবে আশা করি।”

প্রসঙ্গত, এ পর্যন্ত দেশের ৮৮ জন চিকিৎ​সক কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, যাঁদের অনেকেই ব্যক্তিগত সুরাক্ষাসামগ্রীর অভাব বা নিম্নমানের কারণে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানায় বিএমএ।

মাস্ক কেলেঙ্কারি

বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বেনারকে জানান ‘এন৯৫ মাস্ক’ মূলত বস্তুকণা-পরিশোধনের উপযোগী একটি ‘রেসপিরেটর’ বা শ্বাসমুখোশ, যা মার্কিন সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথের (এনআইওএসএইচ) বায়ু পরিশোধন মানদণ্ড অনুযায়ী তৈরি।

এই মাস্কের মাধ্যমে বাতাসের অন্তত ৯৫ শতাংশ কণা পরিশোধিত হয়। এই মাস্কটি সাধারণত চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা ব্যবহার করে থাকেন।

বাংলাদেশে গত এপ্রিলে হাসপাতালে চিকিৎসাকর্মীদের জন্য এন-৯৫ মাস্কের মোড়কে নকল মাস্ক সরবরাহের ঘটনাটি নজরে আসে।

বিএমএ এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে কড়া সমালোচনা হয়।

বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার প্রেক্ষিতে ঘটনা তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

এর পর গত জুনে, দুদক এন-৯৫ মাস্কসহ সুরক্ষা সামগ্রী কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে একটি অনুসন্ধান দল গঠন করে।

দলটি মামলায় অভিযুক্ত সাতজনসহ সরকারের সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর ডিপো (সিএমএসডি) ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আরো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

“অনুসন্ধানে যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাঁদের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে,” বলেন দুদক সচিব।

মামলা প্রধান আসামি সিএমএসডির সাবেক উপ-পরিচালক ডা. জাকির হোসেন বর্তমানে কক্সবাজার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কর্মরত। দ্বিতীয় আসামি সিএমএসডির সহকারী পরিচালক (সংরক্ষণ ও বণ্টন) ডা. মো. শাহজাহান স্বপদেই আছেন।

তৃতীয় আসামি সিএমএসডির সাবেক চিফ কো-অর্ডিনেটর (মনিটরিং ডেস্ক-১১) ডা. জিয়াউল হককে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। চতুর্থ আসামি চিফ কো-অর্ডিনেটর (মনিটরিং ডেস্ক-৮) ডা. সাব্বির আহমেদ বর্তমানে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা।

পঞ্চম আসামি সিএমএসডির স্টোর অফিসার কবির আহমেদ অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) ভোগ করছেন এবং ষষ্ঠ আসামী জ্যেষ্ঠ স্টোর কিপার মো. ইউসুফ ফকির স্বপদে আছেন।

“যাদের যোগসাজশে, সহায়তায়, অংশগ্রহণে, সুরক্ষায় অনিয়মটা হয়েছে, তাঁদের যদি একইভাবে বিচারের আওতায় আনা না হয়, তাহলে দুর্নীতি আরো বিকশিত হওয়ায়ই স্বাভাবিক। দুদককেও এর দায় নিতে হবে,” বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

“এভাবে দুদক সাময়িকভাবে বাহবা নিতে পারবে। কিন্তু দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে তার কোনো সুফল আমরা পাব না,” যোগ করেন তিনি।

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে গত আগস্টে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক।

চিকিৎসকদের নিম্নমানের সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ ও রিজেন্ট হাসপাতাল, জেকেজি হেলথ কেয়ারের করোনাভাইরাস পরীক্ষা ও চিকিৎসায় জালিয়াতি প্রকাশ হওয়ার পর তীব্র সমালোচনার মুখে গত ২১ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র দেন ডা. আজাদ।

ওই সময় প্রতারণার দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদের বিরুদ্ধে নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ।

এর আগে গত ৩০ জুন মহামারি মোকাবেলায় অনিয়ম-দুর্নীতি ও সমন্বয়হীনতার অভিযোগ তুলে সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের অপসারণ দাবি করেছিলেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা) ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা।

দুদকের অভিযোগ

এজাহারে জানানো হয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অথবা সন্দেহভাজন রোগীদের চিকিৎসা করার জন্য ডাক্তার-নার্স এবং অন্যান্যদের সুরক্ষায় এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের জন্য জেএমআই গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করেছিল সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তারা ২০ হাজার ৬১০টি মাস্ক সরবরাহ করে। পরবর্তীতে দেখা যায় যে ওই মাস্কগুলো প্রকৃত এন-৯৫ মাস্ক নয়।

দুদক সচিব জানান, সিএমএসডির নিয়ম অনুযায়ী ‘সার্ভে কমিটির’ মাধ্যমে যাচাই করে পণ্য গ্রহণ করার কথা থাকলেও তা না করেই জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডের সরবরাহ করা নকল ‘এন-৯৫ মাক্স’ গ্রহণ করে ১০টি প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করেন ওই কর্মকর্তারা।

“এভাবে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্সসহ অন্যান্যদের মৃত্যুর ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়,” উল্লেখ করেন সচিব।

জেএমআই গ্রুপের মুখপাত্র আ ফ ম রিয়াজ উদ্দিন মানিক বেনারকে বলেন, “আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছি, এটা নিছকই একটি অনিচ্ছাকৃত ভুল। যদিও করোনা মহামারির মধ্যে এই ভুলটা হওয়া উচিত ছিল না। তবে এর ব্যাখ্যাও আমরা প্রথম থেকেই দিয়ে আসছি।”

“আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যে কারণে এখন আদালতেই বিষয়টি মোকাবেলা করব,” উল্লেখ করে তিনি জানান, জেএমআই গ্রুপের ৩১টি প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে সাত হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তিন লাখ ৬২ হাজার ৪৩ জন, মৃত্যু হয়েছে পাঁচ হাজার ২১৯ জনের।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তিন কোটি ৩৪ লাখ ৫৪ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ১০ লাখ তিন হাজারের বেশি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।