বিশ্বব্যাংকের জরিপ: করোনায় কাজ হারিয়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ৭৪ লাখ মানুষ

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.10.21
ঢাকা
201021_SME_Survey-1000.jpg সিরাজগঞ্জের রতনকান্দি হাটে বাঁশ-বেতের তৈরি সেচযন্ত্র 'হেওত' বিক্রি করছেন এক কুটিরশিল্পী। ১৮ অক্টোবর ২০২০।
[ফোকাস বাংলা]

দুই কোটির বেশি মানুষের কর্মসংস্থান, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ৩৭ ভাগ কর্মী করোনা মহামরির কারণে সাময়িক অথবা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি)।

বুধবার প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়, করোনার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতে (এসএমই) সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ক্ষতির শিকার হয়েছে।

বাংলাদেশের মোট কর্মসংস্থানের শতকরা ৩৫ ভাগ রয়েছে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২০ ভাগ যোগান দেয়া এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতে।

করোনাভাইরাসের কারণে এসএমই খাতের ৯৪ ভাগ প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানানো হয় এই জরিপে।

জুন মাসে টেলিফোনের মাধ্যমে সাক্ষাতকার গ্রহণ করে এই জরিপ প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে।

গড়ে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার ৩০০ আক্রান্ত ও ৪০ জনের মৃত্যুসহ গত জুনে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি ছিল।

জুনের পর থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরায় শুরু হলে আবার প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করে এসএমই খাত।

“বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এসএমই খাতের গুরুত্ব বিশাল,” বলে মন্তব্য করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বেনারকে বলেন, “করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে এসএমই খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর একটি। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে পড়েছে।”

সরকারি হিসাবে, বাংলাদেশে এসএমই খাতে কমপক্ষে দুই কোটি ১০ লাখ মানুষ কর্মে নিয়োজিত। আইএফসি’র হিসাবে করোনার কারণে এই খাতের ৭৪ লাখ মানুষ সাময়িক অথবা স্থায়ীভাবে চাকুরি হারিয়েছেন।

তবে এসএমই খাতের নেতৃবৃন্দ বলছেন, করোনাভাইরাসে এসএমই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়নি। বর্তমানে মহামারির প্রভাব কমে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো আবার কাজ শুরু করেছে।

করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ চাকুরি হারিয়েছেন।

অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে দারিদ্র দূর করতে এসএসই খাতকে বাঁচাতে হবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ

জরিপে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে এসএমই খাতের শতকরা ৯৪ ভাগ প্রতিষ্ঠানে বিক্রি কমেছে। এরপর রয়েছে শ্রীলঙ্কা। সেখানে ৯২ ভাগ প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আফগানিস্তানে ৮৮ ভাগ এবং ভারতে ৮৬ ভাগ এসএমই খাতের প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নেপালে ৮৩ ভাগ এবং পাকিস্তানে সবচেয়ে কম ৬৮ ভাগ এসএমই খাতের প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জরিপে দেশের আট বিভাগের ১২ খাতের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। খাতগুলো হলো, ফ্যাশন, জামাকাপড়, কৃষি, মৎস, খনিজ খাত, পাইকারি বাজার, পরিবহন, খাদ্য, চামড়া, প্লাস্টিক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি।

তথ্য প্রদানকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শতকরা ৯১ ভাগ বলেছে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে তারা স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি অর্থ সংকটে ভুগেছে। ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় এই হার যথাক্রমে শতকরা ৬৬ ও ৬৯ ভাগ।

জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে এসএমই খাতের শতকরা ৮৩ ভাগ প্রতিষ্ঠান আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং শতকরা ৬৪ ভাগ প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান (বিসিক) এর মহাব্যবস্থাপক অখিল রঞ্জন তরফদার বেনারকে বলেন, “২০১৩ সালে বিবিএস’র করা অর্থনৈতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী আমাদের দেশে এসএমই খাতের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৮ লাখ। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী এসএমই খাতে কর্মরত ছিল দুই কোটি ১০ লাখ মানুষ। গত সাত বছরে এসএমই খাতের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমপক্ষে এক কোটি। এই খাতে জড়িত মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে।”

আইএফসির জরিপের ফলাফলকে ‘গ্রহণযোগ্য মনে হয়’ জানিয়ে তিনি বলেন, “জুন-জুলাই মাসে আমাদের ক্ষুদ্রও মাঝারি শিল্পের খুব খারাপ অবস্থা ছিল। অনেক কারখানাই বন্ধ হয়ে যায়। তবে এখন অবস্থা অনেক ভালো বলা যায়।”

অখিল রঞ্জন বলেন, “এই খাতের গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার এসএমই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সহয়তা নিয়ে পুনরায় কর্মকাণ্ড শুরু করতে পারে।”

“বর্তমানে এই খাতকে চাঙ্গা করতে আমরা বিসিক ভবনে মেলার আয়োজন করেছি যাতে মানুষ এই শিল্পকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন,” বলেন অখিল রঞ্জন।

তবে আইএফসি’র গবেষণা ফলাফলের সাথে “পুরোপুরি একমত নই” বলে মন্তব্য করেন এসএমই ফাউন্ডেশনের সহকারি মহাব্যবস্থাপক আবু মঞ্জুর সাইফ।

তিনি বেনারকে বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ধাক্কা লেগেছে সেটি সত্য। তবে সব কারখানা বন্ধ হয়নি।”

এসএমই খাতে কর্মসংস্থান কমেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন আমাদের খাত আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। যারা জামা বানাতেন তারা এখন মাস্ক অথবা অন্য কিছু বানাচ্ছেন। অর্থাৎ, তাঁরা বসে নেই।”

গত এপ্রিলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য সরকার ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার বরাত দিয়ে সাইফ বলেন, “আশানুরূপ না হলেও আমরা প্রণোদনার অর্থ পাচ্ছি। আমরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।”

“আমরা যদি আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজার কাজে লাগাতে পারি তাহলেই আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব,” বলেন সাইফ।

এসএমই খাতের জন্য সরকার ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনাকে “একটি ভালো সিন্ধান্ত” হিসেবে আখ্যায়িত করে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “তবে ব্যাংকগুলো যেন প্রণোদনার টাকা সময়মতো ছাড় করে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।