করোনাভাইরাস: সংক্রমণ কমে আসলেও সামনে ঝুঁকি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা
2021.11.12
ঢাকা

প্রায় নয় মাস পর দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণে দৈনিক মৃত্যুর হার দশের নিচে এসে পৌঁছেছে। বৃহস্পতিবার একজনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, শুক্রবার মারা গেছেন পাঁচ জন। এর আগে এ বছর ১২ ফেব্রুয়ারি পাঁচজনের মৃত্যু হয়।
এছাড়া বৃহস্পতি ও শুক্রবার পরীক্ষা করা নমুনার বিপরীতে দৈনিক শনাক্তের হার ছিল এক শতাংশের কাছাকাছি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, জনসচেতনতা ও টিকাদানের কারণেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমেছে। তবে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষের অনীহা আবারো সংক্রমণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
“সংক্রমণ হার ও মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসার কারণ হলো, এ বছর জুন থেকে আগস্ট মাসে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার পর মানুষ মাস্ক ব্যবহার শুরু করে। পাশাপাশি আমরা টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি,” শুক্রবার বেনারকে বলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এস. এম. আলমগীর।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে টিকা কার্যক্রম শুরুর পর শুক্রবার পর্যন্ত তিন কোটি ২৫ লাখের বেশি মানুষ দুই ডোজ টিকা এবং পাঁচ কোটি ১১ লাখের বেশি মানুষ প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন বলে জানান ড. আলমগীর।
তিনি বলেন, সরকার চীনের তৈরি সাত কোটি সিনোফার্ম টিকা কিনেছে এবং সেগুলোর সরবরাহ নিয়মিত আসছে। সিনোফার্ম ছাড়াও জানুয়ারি মাসের মধ্যে আমেরিকার তৈরি তিন কোটি ফাইজার টিকা বাংলাদেশে আসবে।
সংক্রমণ ও মৃত্যুর প্রবণতা
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে ২০২০ সালের ৮ মার্চ। ১৮ মার্চ এই ভাইরাসে প্রথম রোগীর মৃত্যু ঘটে।
এরপর থেকে ধীরে ধীরে এই সংক্রমণ বাড়তে থাকে। সে বছর জুন-জুলাই মাসের শুরুর দিকে সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ে ২ জুলাই ২০২০ তারিখে সর্বোচ্চ চার হাজার ১৯ জন রোগী শনাক্ত হন, ৩০ জুন সর্বোচ্চ ৬৪ জন মানুষ প্রাণ হারান।
এরপর থেকে ধীরে ধীরে প্রথম ঢেউয়ের সংক্রমণ কমতে থাকে। ৪ অক্টোবর সংক্রমণের সংখ্যা ছিল এক হাজার ১২৫। ১৪ অক্টোবর ২০২০ তারিখে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৬ জন।
কমতির এই ধারা অব্যাহত ছিল ২০২১ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত, ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক মৃত্যু ছিল পাঁচজন।
এই নিম্ন সংক্রমণের মধ্যেই এই বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে টিকা কার্যক্রম শুরু করে সরকার।
তবে ধীরে ধীরে আবার সংক্রমণ বাড়তে থাকে; শুরু হয় করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ। ৭ এপ্রিল দৈনিক সংক্রমণ বেড়ে দাঁড়ায় সাত হাজার ৬২৬। ৫ আগস্ট দৈনিক সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের প্রাণহানি ঘটে।
এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে আবার কমতে থাকে সংক্রমণ। ১১ নভেম্বর দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় একজনে এবং নতুন রোগীর সংখ্যা ছিল ২৩৭ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১২ নভেম্বর বুলেটিনে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত মোট নতুন করে ২২১ জন রোগী করোনাভাইরাসে নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন এবং মারা গেছেন পাঁচজন। দৈনিক শনাক্ত হার শতকরা এক দশমিক দুই ভাগ।
এপর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে ২৭ হাজার ৯১৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সংক্রমিত হয়েছেন ১৫ লাখ ৭২ হাজারের বেশি মানুষ।
আবার বাড়বে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোনো দেশে একটানা চার সপ্তাহ দৈনিক শনাক্তের হার শতকরা পাঁচ ভাগের নীচে থাকলে সেই অবস্থাকে নিয়ন্ত্রিত হিসেবে গণ্য করা যায় বলে শুক্রবার বেনারকে জানান আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন।
তাঁর মতে, বর্তমানে দেশে দৈনিক শনাক্তের হার শতকরা দুই ভাগের নিচে হলেও “এটি আবার বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
তিনি বলেন, “টিকা আমাদের সংক্রমণ ঠেকাতে পারবে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যারা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মানুষকে টিকা দিতে পেরেছে সেখানেও সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
“টিকা মানুষের মৃত্যু ঝুঁকি কমায়। হাসপাতালের ওপর এবং সার্বিকভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা বিশেষ করে আইসিইউ এর ওপর চাপ কমায়,” জানিয়ে ড. মোশতাক বলেন, “টিকাদানের দিক থেকে আমরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছি।”
তিনি বলেন, “১৬ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র তিন কোটি ২৫ লাখ মানুষ পূর্ণ ডোজ টিকা নিয়েছেন। যদিও যাঁরা এক ডোজ টিকা নিয়েছেন তাঁরাও কিছুটা সুরক্ষা পাবেন।”
সম্প্রতি শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য করোনার টিকা ‘জরুরি’ উল্লেখ করে ড. মোশতাক বলেন, সেই কর্মসূচিটি এখনো “খুব বেশি দূর এগোয়নি।”
এদিকে এ পর্যন্ত ঢাকায় লাখ খানেক শিক্ষার্থীকে টিকা দেয়া হয়েছে জানিয়ে ড. আলমগীর বলেন, “অচিরেই আমরা স্কুলে স্কুলে গিয়ে বাচ্চাদের টিকা দিয়ে আসব।”
যাঁরা বাইরে চলাফেরা করেন তাঁদের বড়ো একটি অংশের টিকা নেয়া সংক্রমণ কমে আসার “অন্যতম কারণ” বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
তবে তাঁর মতে, “টিকা ছাড়াও আরেকটি বড়ো কারণ হচ্ছে আবহাওয়ার পরিবর্তন।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক নজরুল বলেন, “বাংলাদেশের আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য হলো, অক্টোবর-নভেম্বর মাসে তাপমাত্রা কমে আসে এবং কিছু মৌসুমি ভাইরাসের কারণে ঠাণ্ডা, সর্দি, কাশি, জ্বর ইত্যাদি হয়।”
তিনি বলেন, “ভাইরোলজিতে একটি কথা আছে, ‘ইন্টারফিয়ারেন্স’। এই ‘ইন্টারফিয়ারেন্স’ এর মানে হলো, একটি ভাইরাস আরেকটি ভাইরাসকে শরীরে প্রবেশ করতে দেয় না।”
“অক্টোবর-নভেম্বর মাসে যে ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করে সেগুলো নতুন করে অন্য কোনো ভাইরাসকে ঢুকতে দেয় না। এই ভাইরাস ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে চলে যায়,” বলেন অধ্যাপক নজরুল।
তিনি বলেন, “এই মৌসুমি ভাইরাসগুলো চলে যাওয়ার পর করোনাভাইরাস নতুন করে বিস্তার লাভ করতে পারে। সেজন্য আমাদের সচেতন থাকতে হবে। মাস্ক পরতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে এবং টিকা নিতে হবে।”