করোনাকালে দেশে ফিরেছেন সোয়া তিন লাখ প্রবাসী, ঋণ পেয়েছেন মাত্র ৪৪৩ জন
2020.12.18
ঢাকা

করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বিদেশফেরত শ্রমিকদের পুনর্বাসনে সরকার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নিলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১৮ কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
করোনাকালে ফিরে আসা সোয়া তিন লাখের বেশি প্রবাসীর শ্রমিকের মধ্যে এই সুবিধা পেয়েছেন সাড়ে চারশ’ জনের কম।
শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর ইস্কাটনে প্রবাসী কল্যাণ ভবনে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত মাত্র ৪৪৩ জন প্রবাসী এই ঋণ পেয়েছেন।
মহামারির মধ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অভিভাসী শ্রমিকদের চলমান অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার প্রেক্ষাপটে এবার দিবসটি পালন করা হয়। বাংলাদেশে এবার ‘মুজিববর্ষের আহ্বান, দক্ষ হয়ে বিদেশ যান’—এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালিত হয় আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস।
সরকারি হিসাবে, করোনা মহামারির কারণে চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিরে এসেছেন ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ জন প্রবাসী।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মহামারির কারণে বেকার হয়ে দেশে ফেরা শ্রমিকের তুলনায় ঋণ পাওয়া প্রবাসীদের সংখ্যা খুবই কম। ভুক্তভোগীদের মতে, মূলত ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়ার জটিলতা এবং প্রবাসী ব্যাংকের সেবার ত্রুটির কারণেই তাঁরা ঋণ পাচ্ছেন না।
তবে সচিবের মতে, ঋণ গ্রহণে প্রবাসীদের আগ্রহ কম।
তিনি বলেন, “দেশে ফিরে বিমানবন্দর থেকে ওয়েজ আর্নাস বোর্ডের দেওয়া পাঁচ হাজার টাকা নিতে বিদেশ ফেরত শ্রমিকেরা বেশ আগ্রহ দেখান, কিন্তু প্রবাসী ঋণ নিতে তাঁদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই।”
এদিকে “শুরুর দিকে ঋণের প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে” আবেদন করেও শ্রমিকরা ঋণ পাননি বলে বেনারকে জানান ব্রাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান।
তিনি বলেন, “ঋণ পাওয়ার জন্য প্রবাসীদের কাছে যেসব ডকুমেন্ট চাওয়া হতো অনেক সময় সবগুলো দেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হতো না।”
“তা ছাড়া মানুষের টাকার চাহিদা থাকলেও তাদের দোড়গোঁড়ায় প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক সেবা পৌঁছে দিতে পারছে না,” বলেন শরিফুল হাসান।
দেশে ফেরা তিন লাখেরও বেশি প্রবাসীদের মধ্যে মাত্র ৪৪৩ জন ঋণ পাওয়া দুঃখনজক উল্লেখ করে শরিফুল হাসান বলেন, “আমি মনে করি ঋণ নেওয়ার মতো অন্তত ৫০ হাজার প্রবাসী আছেন।”
তাঁর মতে, “অভিবাসনপ্রবণ এলাকাগুলোতে এই বিশেষ ব্যাংকের সেবা বাড়ালে ভুক্তভোগীরা সহজে এই ঋণ পেতেন।”
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে আত্মপ্রকাশ করা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সারা দেশে মাত্র ৬৬টি শাখা রয়েছে।
শর্তের জটিলতা
করোনাকালে কাজ হারিয়ে দেশে ফেরা এবং বিদেশে মৃত্যুবরণকারীদের পরিবারের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে ২০০ কোটি টাকা এবং প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সহজ শর্তে বিদেশ ফেরত কিংবা বিদেশে মারা যাওয়া প্রবাসীর কোনো বৈধ প্রতিনিধিকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে ৪ শতাংশ সুদে এই টাকা ঋণ দেয়ার কথা। গত ১৫ জুলাই থেকে এই ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
কিন্তু ঋণ পেতে নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে ভুক্তভোগীরা শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছেন। বিশেষ করে নানা শর্তের জালে ঋণ আটকে যাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন অনেকে।
করোনাভাইরাসের কারণে কুয়েত থেকে বেকার হয়ে দেশে ফিরেছেন কুমিল্লা সদরের বাসিন্দা এমদাদুল হক সোহেল।
তিনি বেনারকে জানান, দেশে ব্যবসা করার ইচ্ছায় প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণের আবেদন করেছিলেন। কিন্তু বিদেশে বৈধ শ্রমিক হিসেবে কাগজপত্র না থাকায় ঋণ পাননি তিনি।
সোহেল জানান, ২০১৮ সালে ১০ লাখ টাকা খরচ করে তিনি কুয়েতে যান। সেখানে কাজ করে সেই টাকাও ওঠাতে পারেননি। এর ওপরে করোনাভাইরাসের কারণে চার মাস লক ডাউন থাকায় মালিকের কাছে থাকা পাসপোর্টও সংগ্রহ করতে পারেননি। কারখানা বন্ধ থাকায় সেখানে তাঁর বেতনও বন্ধ ছিল।
“একসময় নিজেদের টাকা শেষ হলে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আউটপাস নিয়ে গত ১৩ মে দেশে ফিরে আসি। এখন প্রবাসী ঋণ পেতে আমাকে পাসপোর্ট দেখাতে হবে। আউটপাস দেখে ঋণ দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে ব্যাংক,” বলেন সোহেল।
একই জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন দুবাই থেকে দেশে ফিরেছেন গত ২২ জুলাই।
প্রবাসী ঋণের ব্যাপারে বিদেশে থাকতে একটু আধটু শুনেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশে ফিরে বিভিন্ন ব্যাংকে চাকরি করেন, এমন কয়েকজনের কাছে খোঁজখবর নিয়েও বিস্তারিত জানতে পারিনি।”
শর্ত সহজ হয়েছে
“প্রথম দিকে ঋণ পাওয়ার শর্ত নিয়ে কিছু সংশয় ছিল। শাখা অফিসগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পারত না,” জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সচিব মুনিরুছ সালেহীন জানান, “সেগুলো আমরা দূর করেছি।”
“আশা করছি গত ৬ মাসের তুলনায় আগামী ৬ মাসে ঋণ নেয়ার সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়বে,” বলেন প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের এই চেয়ারম্যান।
এছাড়া “আগের চেয়ে ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়া অনেক সহজ হয়েছে,” বলেও জানান সচিব।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর অভিবাসী কর্মীদের পুনর্বাসন ঋণ নীতিমালার সংশোধনী প্রকাশ করা হয়। এতে চলতি বছরের প্রথম দিন থেকে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেশে ফেরত আসা অভিবাসী কর্মীরা ঋণ আবেদন করতে পারবেন বলে বলা হয়েছে।
আগের নীতিমালায় প্রবাসীর বহির্গমন ও আগমনের সিলসহ পাসপোর্টের ফটোকপি ও বৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার নথি উপস্থাপন করতে হতো। সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী, ঋণ পেতে প্রবাসীরা ট্রাভেল পাসের ফটোকপি জমা দিতে পারবেন।
এছাড়া এই ঋণের নীতিমালা অনুযায়ী, এক ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ পর্যন্ত ঋণ দিতে পারবে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। সরল সুদের এই ঋণের মেয়াদ হবে খাত অনুযায়ী ১ থেকে ৫ বছরের মধ্যে।
তবে যে কোনো পরিমাণ ঋণের ক্ষেত্রে প্রকল্প, ব্যবসার মালামাল বা অস্থাবর ও অন্যান্য সম্পদ প্রাথমিক জামানত হিসেবে দায়বদ্ধ থাকবে ব্যাংকের কাছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন চার লাখ ৯৮ হাজার ২৯৩ জন, মৃত্যু হয়েছে সাত হাজার ২১৭ জনের।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন সাত কোটি ৫৩ লাখ ৩৪ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ১৬ লাখ ৬৯ হাজারের বেশি।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে পুলক ঘটক।