ক্যাসিনোর ‘পথিকৃৎ’ আওয়ামী লীগ নেতা এনু-রূপন গ্রেপ্তার
2020.01.13
ঢাকা

অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার ‘পথিকৃৎ’ হিসাবে পুলিশের কাছে পরিচিত পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু এবং তাঁর সহোদর ভাই রূপন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হওয়া ক্যাসিনো ও দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের সময় তাঁদের বাসা ও ঘনিষ্ঠ লোকজনদের কাছ থেকে আট কেজি স্বর্ণ ও কয়েক কোটি টাকা ভর্তি সিন্দুক পাওয়া যায়। কিন্তু তখন তাঁদের গ্রেপ্তার করা যায়নি।
গত ৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে ঘোষণা দেবার সাতদিনের মাথায় সিআইডি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলেন এনু-রূপন।
সিআইডি কর্মকার্তারা বলছেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা এলাকার একটি বাড়ির ফলস সিলিং থেকে টেনে বের করা হয় এই দুই ভাইকে।
সিআইডি’র পুলিশ উপ-মহাপরিদর্শক ইমতিয়াজ আহমেদ বেনারকে জানান, এনামুল হক এনু গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও তাঁর ভাই রূপন গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এই দুই ভাই ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের পরিচালক।
“এনু-রূপন দুই ভাই বাংলাদেশে ক্যাসিনো ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ পাচারের পথিকৃৎ। তাদের উত্থান জুয়া দিয়ে,” বলেন ইমতিয়াজ আহমেদ।
এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে সিআইডি অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার মাধ্যমে টাকা লেনদেন অর্থ পাচারের আওতায় পড়ে।”
তিনি বলেন, “অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা শুরুর পর এদের গ্রেপ্তার একটি বড় অর্জন বলা যায়। অভিযান শুরুর পর থেকে তারা পলাতক ছিল। তাদের বাসা ও কাছের লোকদের কাছ থেকে সিন্দুক উদ্ধার করা হয়। সিন্দুকে কোটি কোটি টাকা ও স্বর্ণ পাওয়া যায়।”
অর্থ পাচার মামলায় অভিযুক্ত হলে দুই ভাইর সর্বোচ্চ ১২ বছর কারদণ্ড হতে পারে জানিয়ে ইমতিয়াজ বলেন, “প্রাথমিক জিঞ্জাসাবাদে তারা স্বীকার করেছে যে ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকায় মোট ২২টি বহুতল বাড়ি ও জমি রয়েছে।”
“এনু-রূপনকে গ্রেপ্তারে পরিচালিত অভিযানে তাঁদের বাসা থেকে আট কেজির বেশি স্বর্ণ ও পাঁচ কোটি পাঁচ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়,” যোগ করেন ইমিতিয়াজ।
তিনি বলেন, বিভিন্ন ব্যাংকে তাঁদের নামে ৯১টি হিসাব রয়েছে। এসকল হিসাবে ১৯ কোটি ১১ লাখ টাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো বর্তমানে ফ্রিজ করা আছে।
ইমতিয়াজ জানান, আগামীকাল (মঙ্গলবার) দুই ভাইকে আদালতে উপস্থাপন করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে।
“দুই ভাই ভুয়া পাসপোর্ট করে ভারত হয়ে নেপাল পালাতে চেয়েছিল বলে পুলিশকে জানায়। এনু তার ভুয়া পাসপোর্টে শেখ সানি নাম ব্যবহার করেছে,” বলেন ইমতিয়াজ আহমেদ।
সেপ্টেম্বরে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানে পলাতক দুই নেতার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা হয়। সেই মামলার তদন্ত করছে সিআইডি।
যেভাবে গ্রেপ্তার
সিআইডি’র বিশেষ পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন বেনারকে বলেন, “ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর এনু-রূপন দুই ভাই আত্মগোপনে চলে যায়। তাদের ধরা যাচ্ছিল না।”
তিনি বলেন, “আমরা প্রযুক্তির সহয়তায় তাদের ঢাকার কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা এলাকার একটি বাসায় শনাক্ত করি। সেই বাড়ির প্রতিটি তলায় খুঁজেও তাঁদের পাওয়া যাচ্ছিল না।”
“আমরা একটি তলার একটি মাস্টার বেডরুমে দেখলাম আধা পোড়া সিগারেটের টুকরায় তখনও আগুন জ্বলছে। এটা দেখে আমরা বুঝলাম এরা এখানেই আছে। কিন্তু তাদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না,” যোগ করেন তিনি।
ফারুক বলেন, “হঠাৎ আমরা দেখি কাগজ দিয়ে ঘরের ফলস সিলিং ঢেকে দেয়ার পর ওপরের দিকে কিছুটা ফাঁকা আছে। সেখানে টর্চ মেরে দেখি ওদের পা দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে ওদের পরে বের করে আনা হয়।”
তিনি বলেন, “গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ১২টি মোবাইল ফোন এবং ৪০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।”
বড় দুর্নীতিবাজদের আড়ালের চেষ্টা: বিএনপি
প্রধান বিরোধীদল বিএনপির মতে সরকারের এসকল দুর্নীতি বিরোধী অভিযান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালনা করা হচ্ছে।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেনারকে বলেন, “ক্যাসিনো কাণ্ডে আটক সবাই আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা। এগুলো পরিচালনা করার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক।”
তিনি বলেন, “গতবছর ভোট চুরি করে ক্ষমতায় আসার কারণে জনগণের মধ্যে তাদের কোনো জনপ্রিয়তা নেই। গায়ের জোরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে তারা। এখন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য তথাকথিত এই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে, জনগণকে ধোঁকা দেয়া হচ্ছে।”
মির্জা ফখরুল বলেন, “ছোট ছোট দুর্নীতিবাজদের ধরে বড় বড় দুর্নীতিবাজদের আড়াল করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।”
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “আমরা ক্যাসিনো এবং অর্থ পাচারের সাথে যুক্তদের ছাড় দেবো না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে একথা বলেছেন। এটি জাতির কাছে আমাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারই প্রথম দেখিয়েছে যে অন্যায় যেই করুক, এমনকি নিজের দলের হলেও ক্ষমা করা হবে না। শাস্তি পেতে হবে।”
গতবছর সেপ্টেম্বর অনেকটা হঠাৎ করেই ঢাকার বিভিন্ন নামীদামী ক্লাবগুলোতে পরিচালিত অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করে র্যাব।
ওই সময় ক্যাসিনোর সাথে যুক্ত নেতাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও অন্যান্য দ্রব্যাদি উদ্ধার করা হয়।
ক্যাসিনোর সাথে যুক্তদের প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতা।
তাঁদের অন্যতম হলেন, যুবলীগ উত্তরের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১০ জনকে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা ও অর্থ পাচারের দায়ে আটক করা হয়েছে।
আরও অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে সিআইডি।