দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব সরকার, চলছে অভিযান
2019.01.24
ঢাকা

ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম মাসেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশ সরবে যুদ্ধ শুরু করেছে সরকার। এ ব্যাপারে ‘জিরো-টলারেন্স’ দেখানোর অঙ্গীকার করে টানা তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের পরই কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নবনিযুক্ত মন্ত্রীরাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো ভাষায় কথা বলছেন। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান। যদিও বিশ্লেষকেরা বলছেন, সুবিধাভোগী ও দলীয় লোকজনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত সরকারের অবস্থান বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “সরকারকে প্রথমে নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। প্রথম দুই মেয়াদে, অর্থাৎ বিগত দশ বছর ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে যারা হৃষ্টপুষ্ট হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এই দুর্নীতি বিরোধী অভিযান বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে না।”
তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বেনারকে বলেন, দুর্নীতি দমনে নতুন সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার তাঁদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে দুদক।
“আগামী দুই মাসের মধ্যে আমাদের অনেকগুলো পদক্ষেপের অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে,” যোগ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কোনো দেশেই দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী ইশতেহার এবং দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকার প্রধান এখন পর্যন্ত যা বলেছেন তা রাজনৈতিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। এর ফলে জনমনে আশার সঞ্চার হয়েছে।”
“দুর্নীতি রোধ করা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে সরকার সফল হবে,” বলেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামা সংগ্রহ করা হচ্ছে উল্লেখ করে দুদক চেয়ারম্যান জানান, যাদের হলফনামায় উল্লেখিত সম্পদের বিবরণীতে অসংগতি পাওয়া যাবে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া “সরকারের যেসব বিভাগের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বেশি তার সবগুলোতে অভিযান চালানো হবে,” বলেন তিনি।
শুরুতেই কঠোর সরকার
মন্ত্রিপরিষদ গঠনের পর থেকেই সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ও তাঁর মন্ত্রীবর্গ ক্রমাগতভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিচ্ছেন। গত ১৭ জানুয়ারি সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী।
সেদিন দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “মাদকের বিরুদ্ধে যেভাবে অভিযান চলছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধেও অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
“সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, মাদকের মতো দুর্নীতির বিরুদ্ধেও আমি জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা দিয়েছি,” যোগ করেন শেখ হাসিনা।
নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংকিং খাতের অর্থ আত্মসাতের মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত এবং বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। এই খাতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ ও দুর্নীতিগ্রস্তদের পদোন্নতি বন্ধ এবং বিদেশে অর্থ পাচার রোধে টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য একটি বিশেষ তদারকি সেল খোলা হবে বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ ছাড়া সম্পদের হিসাব বিবরণী হালনাগাদ, আর্থিক তথ্যাবলী জাতীয় নেটওয়ার্কের আওতায় আনাসহ সততার জন্য পুরস্কার চালু করা হচ্ছে।
সরকার মনে করছে, এর ফলে দুর্নীতি দৃশ্যমান হারে কমে আসবে। এরই মধ্যে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী তাঁর মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সম্পদের হিসাব দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
গা ঝাড়া দিয়েছে দুদক
সরকারের ‘সবুজ সংকেত’ পেয়ে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা দুদক সর্বশেষ বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়েছে। একইদিন দেশের তিন জেলা থেকে ব্যাংকার, সার্ভেয়ার ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) এক চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করেছে সংস্থাটি।
এর আগে মঙ্গলবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা ও বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালু এবং তাঁর স্ত্রী মাহবুবা সুলতানার বিরুদ্ধে প্রায় ২২ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের দুটি মামলার চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে বলে বেনারকে জানান সংস্থার জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য।
এর আগেই সরকারি বিভিন্ন দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে অভিযান শুরু করে দুদক। গত সোমবার রাজধানীসহ দেশের আটটি জেলার ১১টি সরকারি হাসপাতালে অভিযান চালায় তারা। হাসপাতালগুলোতে ৪০ শতাংশ চিকিৎসকই কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন।
উপজেলা পর্যায়ে অনুপস্থিতির হার প্রায় ৬২ শতাংশ বলে দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এ অভিযান প্রসঙ্গে রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এম এইচ চৌধুরী লেলিন বেনারকে বলেন, “যেসব চিকিৎসক সরকারি চাকরিতে থেকেও নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিলে কেউ আপত্তি করবে না।”
“তবে সকল সেক্টরের দুর্নীতিই ধরা উচিত। পক্ষপাতদুষ্ট অভিযান হলে মানুষ তা সমর্থন করবে না,” যোগ করেন এই চিকিৎসক।
দুদক চেয়ারম্যান জানান, স্বাস্থ্যের পাশাপাশি গণপূর্ত, ভূমি, সড়ক ও জনপদ, রাজস্ব, শুল্কসহ প্রতিটি দুর্নীতিগ্রস্ত বিভাগ বা প্রতিষ্ঠান তাঁদের নজরাদারিতে রয়েছে। গত ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে অভিযান চালিয়ে ঘুষের টাকাসহ এক রাজস্ব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেন তাঁরা।
সরিষার মধ্যেও ভূত
দুর্নীতি বিরোধী এই তোড়জোড়ের মধ্যে গত মঙ্গলবার দুদক পরিচালক এ কে এম ফজলুল হককে বরখাস্ত করা হয়। “আসামিদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ এবং অনুসন্ধানের তথ্য ফাঁস” করার অভিযোগে অভিযুক্ত এই কর্মকর্তা সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত-২ বিভাগে কর্মরত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “খারাপ কাজ করলে বহিষ্কার হতেই হবে। তিনি (ফজলুল হক) সদ্য পদোন্নতি পেয়েছিলেন। তারপরও মাফ করা হয়নি। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত যারাই আমাদের নজরে আসবে, তাদের একই পরিণতি হবে।”
ঘুষ দেওয়ার সময় গ্রেপ্তার
দুদকের এক কর্মকর্তাকে ঘুষ দেওয়ার সময় বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে আনসার কমান্ড্যান্ট আশিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এ ঘুষের এক লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। তাঁর বিরুদ্ধে ডবলমুরিং থানায় মামলা হয়েছে।
নীলফামারীর জেলা আনসার কমান্ড্যান্ট আশিকুর রহমান বান্দরবানের ১৭ নম্বর আনসার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় একটি টেন্ডার অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হন বলে অভিযোগ আছে। এই অভিযোগের বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান চলছে।
দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুদক ঘুষ প্রদান ও গ্রহণের ঘটনাগুলো হাতেনাতে ধরার জন্য কঠোর গোয়েন্দা নজরদারি করছে।’