ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে দুদক পরিচালক এনামুল কারাগারে
2019.07.23
ঢাকা
অবশেষে দুর্নীতির দায়ে কারাগারে গেলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির। ঘুষ লেনদেনের মামলায় সাময়িক বরখাস্ত দুদকের এই কর্মকর্তার জামিন নাকচ করে মঙ্গলবার তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয় ঢাকার একটি আদালত।
সোমবার রাতে রাজধানীর একটি বাসা থেকে এনামুল বাছিরকে আটক করে দুদকের একটি দল। এনামুল বাছিরকে ঘুষ দেওয়ার কথা স্বীকার করে এর আগে কারাগারে যান পুলিশের উপ মহাপরিদর্শক মিজানুর রহমান। তিনিও এখন জেলে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, দুদকের একজন কর্মকর্তার দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়া প্রতিষ্ঠানটির দুর্বলতাকেই প্রমাণ করে। অভিযুক্তের যথাপোযুক্ত শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “অভিযোগ ওঠার পরে দুদকের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হলো, এটা আমরা ইতিবাচকভাবে নিতে চাই। আইনগতভাবে তাঁর নায্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে; যাতে শুধু দুদকেরই না, যে কেউ এ ধরনের অপরাধ থেকে বিরত থাকে।”
তিনি বলেন, “এটা শুধুমাত্র একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দুদকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের একাংশের মধ্যে অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিকতা এবং পেশাগত ঘাটতি রয়েছে। যা ব্যাপকভাবে আলোচিত।”
“তাই শুধুমাত্র অভিযোগের প্রেক্ষিতে নয়, দুদকের উচিত স্ব-প্রণোদিতভাবেই পুরো কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে একটা শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা। সৎ উদ্দেশ্য থাকলে দুদকের পক্ষে সেটা করা সম্ভব। আর সেটা করলেই দুদকের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কিছুটা ফিরতে পারে,” বলে ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তবে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বেনারকে বলেন, “এই ঘটনায় দুদকের ভাবমূর্তি কিছুই ক্ষুণ্ন হচ্ছে না। এর দ্বারা প্রমাণিত হলো আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়, সেটা যেই হোক।”
তাঁর মতে, “এনামুল বছির আটক হওয়ার মাধ্যমে দুদকের ভাবমূর্তি বরং উজ্জ্বল হলো। কারণ, দুদক তার একজন কর্মকর্তাকেও রেহাই দিলো না।”
পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানের কাছ থেকে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে গত ১৭ জুলাই এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এই ডিআইজির অবৈধ সম্পদের খোঁজে দুদকের অনুসন্ধানের দায়িত্বে ছিলেন এনামুল বাছির।
সেই তদন্ত চলাকালে ডিআইজি মিজান দাবি করেন, দুদক কর্মকর্তা বাছির তাঁর কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। গত ৮ জুন দুজনের মধ্যকার কথোপকথনের কয়েকটি অডিও ক্লিপও ফাঁস করে দেন ডিআইজি মিজান।
এরই প্রেক্ষিতে এই দুই কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত হন। পরে ১৭ জুলাই দুদকের পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যা তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় কারাগারে রয়েছেন ডিআইজি মিজান। এই মামলায়ও তাঁকে আটক দেখানো হয়েছে।
ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার
মঙ্গলবার এনামুল বাছিরকে আদালতে হাজির করা হলে তাঁর পক্ষে জামিন আবেদন করেন তার আইনজীবী কবির হোসাইন।
পরে বেনারকে তিনি বলেন, "আদালতকে আমি বলেছি, চাকরি জীবনের ২৮ বছরে এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে কখনো ঘুষ গ্রহণ দূরে থাক, ন্যূনতম কোনো অসততার অভিযোগ নেই। ডিআইজি মিজান চক্রান্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের বানোয়াট অভিযোগ এনেছেন।”
কবির হোসাইন আদালতে দাবি করেন, ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে দুদকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর তিনি এনামুল বাছিরকে ঘুষ দেওয়ার ‘মিথ্যা’ দাবি করেন।
ফাঁস হওয়া যে অডিও ক্লিপের ভিত্তিতে মামলা করা হয়েছে সেটি মিথ্যা দাবি করে ডিআইজি মিজানের সাথে এনামুল বাছিরের টেলিফোনে কোনো কথা হয়নি বলেও দাবি করেন কবির হোসাইন। তাছাড়া ওই অডিওর ফরেনসিক পরীক্ষা হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
মিথ্যা মামলায় জড়ানোর অভিযোগ এনে এনামুল বাছিরের জামিন চান তাঁর আইনজীবীরা। তাঁদের অভিযোগ, পদোন্নতি সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করার প্রেক্ষারপটে এনামুল বাছিরকে ষড়যন্ত্র করে এই মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।
দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে
তবে এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে দাবি করে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল তাঁর জামিনের বিরোধিতা করেন।
কাজল আদালতকে বলেন, “ঘুষ গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থপাচারের যথার্থ অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় ডিআইজি মিজান ও এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।”
মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, "ঘুষ গ্রহণ সংক্রান্ত ডিআইজি মিজান ও এনামুল বাছিরের মধ্যকার ফোনালাপের অডিও ক্লিপগুলোর ফরেনসিক রিপোর্ট এসেছে। তাতে গণমাধ্যমে এনামুল বাছিরের দেওয়া সাক্ষাৎকারের কণ্ঠের সঙ্গে ওই অডিওর কথোপকথনে এনামুল বাছিরের কণ্ঠের মিল পাওয়া গেছে।”
দুদকের এই আইনজীবী আদালতকে বলেন, “টাকার লেনদেন হয়েছে। এখানে রাগ-বিরাগের কোনো সুযোগ নেই। তদন্ত চলমান। এনামুল বাছিরকে কারাগারে পাঠানো হোক।”
উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত এনামুল বাছিরের জামিন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এদিকে চলতি বছরের শুরুর দিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচকে বলা হয়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থানের ছয় ধাপ অবনমন ঘটেছে।
তবে টিআই’র এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দাবি করেন, বাংলাদেশে দুর্নীতির পরিস্থিতি ‘নিম্নগতির দিকে’।