আওয়ামী লীগের দুই নেতার বাসায় ক্যাসিনোর পাঁচ কোটি টাকা
2019.09.24
ঢাকা

এবার ঢাকায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় দুই নেতা এবং তাঁদের বন্ধু ও কর্মচারীর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মঙ্গলবার প্রায় পাঁচ কোটি টাকা, আট কেজি সোনা এবং ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন–র্যাব।
ক্যাসিনো ও অবৈধ জুয়ার বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের অংশ হিসেবে গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক রূপণ ভূঁইয়ার বাড়িতে র্যাব–৩ এই অভিযান চালায়।
মঙ্গলবার দুপুরে অভিযান শেষে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক সফিউল্লাহ বুলবুল সাংবাদিকদের জানান, এনামুলের ছয়তলায় বাসার দোতলা ও পাঁচতলা থেকে তিনটি সিন্দুক পাওয়া যায়। অভিযানের সময় একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সিন্দুক খুলে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা ও ৭২০ ভরি স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ৫টি আগ্নেয়াস্ত্রও উদ্ধার করে র্যাব।
র্যাব জানায়, এনামুল ও রূপণ ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের শেয়ার হোল্ডার। তাঁদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগও রয়েছে। তবে সহোদর এই দুই স্থানীয় নেতাকে আটক করা যায়নি।
চলমান এই অভিযানকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। পাশাপাশি এ ধরনের অভিযান চলমান রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন তাঁরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শান্তনু মজুমদার বেনারকে বলেন, “এ ধরনের অরাজকতা আরো আগেই বন্ধ হওয়া উচিত ছিল। তবে দেরিতে হলেও যে শুরু হয়েছে সেটা ইতিবাচক। এটা অতি শুভ উদ্যোগ।”
“তবে এর পেছনে যে চরিত্রগুলো আছে তাদের কতটুকু সামনে আনা যাবে সেটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার সে চ্যালেঞ্জ কতখানি নেবে তা আগামী কিছু দিনের মধ্যে বোঝা যাবে,” বলেন তিনি।
ড. শান্তনু বলেন, “এই অরাজকতার বিরুদ্ধে যে তৎপরতা শুরু হয়েছে সেটা একটা সতর্কবার্তাতো বটেই এবং অনেকের মধ্যে আতঙ্কও শুরু হয়েছে। এই অভিযান চলমান থাকুক। এ ধরনের অপরাধের পেছনে যদি কেউ থাকে তাদেরকেও সামনে এনে আইনের আওতায় আনা হোক।”
এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, “আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতা নজরদারিতে রয়েছেন। অপকর্ম করলে কেউই ছাড় পাবে না।”
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নেতাদের চাঁদাবাজি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এর পরপরই ক্যাসিনো বন্ধে অভিযান শুরু করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার মতিঝিলের ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাব এবং মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রে অভিযান চালায় র্যাব। সে রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে।
২০ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার জি কে শামীমকে। এই দুই যুবলীগ নেতার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ, মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়।
এ ছাড়া রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি সফিকুল আলম ফিরোজকে অস্ত্রসহ আটক করে র্যাব।
স্থান সংকুলানের অভাবে সোনা কিনে রাখতেন
র্যাব জানায়, এনামুলের ভাই রূপণ ইংলিশ রোড থেকে পাঁচটি সিন্দুক কিনেছেন এমন গোয়েন্দা তথ্যের সূত্র ধরে গেণ্ডারিয়ার বানিয়ানগর মুরগিটোলায় এনামুল ও রূপণের বাড়িতে সোমবার মধ্যরাত থেকে অভিযান চালানো হয়।
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক সফিউল্লাহ বলেন, “ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের শেয়ারহোল্ডার এনামুল হক ক্লাব থেকে যে টাকা পেতেন তা বাসায় এনে রাখতেন।”
“সূত্রাপুরের বানিয়ানগরের নিজ বাড়িতে টাকা রাখার জন্য ভল্ট বানান তিনি। তবে সেখানেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় টাকা দিয়ে স্বর্ণালংকার কিনতেন এনামুল,” বলেন তিনি।
এনামুল হক ও তাঁর ভাই রূপণের বাড়িতে অভিযানের পরে তাঁদের এক বন্ধু ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের এক কর্মচারীর বাসায় অভিযান চালিয়ে চার কোটি টাকা ও একটি অস্ত্র জব্দ করে র্যাব।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, তথ্যের ভিত্তিতে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের কর্মচারী আবুল কালাম ও এনামুলের বন্ধু হারুন অর রশিদের বাসায় অভিযান চালানো হয়। তবে অভিযানের আগেই তাঁরা পালিয়ে যান।
তিনি জানান, লালমোহন সাহা স্ট্রিটে এনামুলের কর্মচারী আবুল কালামের বাসায় একটি সিন্দুক পাওয়া যায়। সেটি ভেঙে দুই কোটি টাকা ও একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়।
“এছাড়া শরৎগুপ্ত রোডে এনামুলের বন্ধু হারুন-অর-রশিদের বাসায় আরেকটি সিন্দুকের সন্ধান মেলে। সেখান থেকে আরও অন্তত দুই কোটি টাকা পাওয়া যায়,” বলেন তিনি।
সফিউল্লাহ বলেন, “হারুনের স্ত্রী দাবি করেছেন, জব্দ হওয়া টাকাগুলো কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক তাঁদের (হারুন) বাড়িতে রেখে যান।”
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, সপ্তাহ খানেক আগে এনামুল থাইল্যান্ডে চলে গেছেন। তার ভাই রূপণও পলাতক। র্যাব তাঁকে খুঁজছে। রাজধানী ঢাকায় এই দুই ভাইয়ের অন্তত ১৫টি বাড়ি রয়েছে জানা যায়। সব বাড়িই পুরান ঢাকা এলাকায়। দুটি টিনশেডসহ এসব বাড়ির তিনটি গত ছয় মাসে কেনা হয়।
ক্যাসিনোর বৈধতা নিয়ে দ্বন্দ্বে সরকার
এদিকে চলমান অভিযানের মধ্যে দেশে ক্যাসিনোর বৈধতার বিষয়ে বেশ দ্বন্দ্বে পড়েছে সরকার। বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিবুল হক সাংবাদিকদের জানান, “কক্সবাজারে প্রস্তাবিত বিশেষ পর্যটন অঞ্চলে ক্যাসিনোসহ আধুনিক সব আয়োজন থাকবে। সেসব ক্যাসিনোতে শুধুমাত্র বিদেশিরা পাসপোর্ট দেখিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন।”
তিনি বলেন, “পর্যটকদের জন্য ক্যাসিনো দরকার। আমরা যেখানে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন করব, সেখানে বিদেশিদের জন্য এসব সুযোগ-সুবিধা থাকবে।”
তবে এদিন সচিবালয়ে পৃথক এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “নীতিমালার মধ্যে এনে দেশে ক্যাসিনো চালু করা হবে, নাকি একেবারেই বাদ দেওয়া হবে, এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”