উত্তর কোরীয়দের সাথে অনলাইন ক্যাসিনো বাণিজ্যে যুক্ত সেলিম গ্রেফতার
2019.10.01
ঢাকা

উত্তর কোরীয়দের যোগসাজশে অনলাইনে ক্যাসিনো ব্যবসা চালুর অভিযোগে সেলিম প্রধান নামে বাংলাদেশের এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থাই এয়ারওয়েজের ব্যাংককগামী বিমান থেকে সোমবার দুপুরে আটক হন তিনি।
র্যাবের মুখপাত্র (ভারপ্রাপ্ত) লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জানান, গত এক বছর ধরে উত্তর কোরিয়ার এক ব্যবসায়ীর সাথে যৌথ মালিকানায় অনলাইন ক্যাসিনো বাণিজ্য পরিচালনাকারী সেলিম দেশ থেকে নিয়মিত অর্থ পাচার করেছেন।
সেলিমের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর গুলশান ও বনানীর কার্যালয় থেকে অনলাইন ক্যাসিনো বাণিজ্যের সরঞ্জাম ও তথ্য-উপাত্ত উদ্ধারের পর মঙ্গলবার বিকেলে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন সারওয়ার।
“একটি বড় সার্ভার, যার মধ্যে অনলাইনের এই খেলাটি সংরক্ষণ করে রাখা হতো এবং চারটি ল্যাপটপ আমরা জব্দ করেছি,” বলেন র্যাব-১ এর এই অধিনায়ক।
সারওয়ার জানান, জুয়ায় অংশ নেওয়া সবার টাকা একাধিক ‘গেটওয়ের’ মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহে ‘ব্যাংক অব সিলন, কমার্শিয়াল ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংকের’ তিনটি হিসাবে স্থানান্তর করা হতো। এই তিনটি হিসাব থেকে চেক দিয়ে বা নগদ নিয়ে তা অন্য দুটি ব্যাংক হিসাবে জমা রাখা হতো।
“শেষ দুটি হিসাব থেকে টাকা তুলে হুন্ডির মাধ্যমে বা নিজেরা বহন করে তাঁরা বিদেশে পাচার করতেন। অনেক সময় এই টাকা নিতে কোরিয়ানরাও আসতেন,” উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা জানান, সেলিম প্রধানের ৭৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা মূল্যের ২৩টি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা এবং নগদ ২৯ লাখ পাঁচ হাজার টাকা, ১৩ টি ব্যাংকের ৩২টি চেকবই এবং ১২টি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, “শুধুমাত্র একটা ‘গেটওয়েতে’ মাত্র এক মাসেই জমা হয়েছে প্রায় নয় কোটি টাকা। আরও কিছু গেটওয়ে আছে। এ থেকে আমরা আন্দাজ করতে পারি গত এক বছরে কী পরিমাণ টাকা বাংলাদেশ থেকে চলে গিয়েছে।”
অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ‘অনলাইন গেটওয়ের’ মাধ্যমে যখন টাকা জমা হচ্ছিল, তখনই ব্যাংকগুলোর এ ব্যাপারে নজর দেওয়ার কথা। এই টাকার সূত্র কী, সেটা খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল।”
“এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতা রয়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটেরও (বিএফআইইউ) আরো তৎপর হওয়া উচিত,” যোগ করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই অর্থ উপদেষ্টা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “এ ব্যাপারে আমি এখনই কোনো মন্তব্য করতে পারব না।”
“সম্প্রতি ক্যাসিনো কাণ্ডে যতগুলো ব্যাংক হিসাব জব্দের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় নয়, বিএফআইইউ-এর স্বতন্ত্র সিদ্ধান্তে হয়েছে,” বলেও জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা।
অন্যদিকে আজিজুল বলেন, “এভাবে অবৈধ অর্থ উপার্জন এবং তা পাচার ঠেকানো না গেলে দেশের অর্থনীতিতে শুধু নয়, তা সামগ্রিক সামাজিক নৈতিকতায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
পালাতে চেয়েছিলেন সেলিম
কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত হওয়ার বিষয়টি সাইবার মনিটরিং সেলের মাধ্যমে র্যাবের নজরে আসে উল্লেখ করে সারওয়ার বলেন, “এরই মধ্যে গতকাল (সোমবার) জানতে পারি এই ব্যবসার হোতা সেলিম প্রধান বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এরপরই তাঁকে গ্রেপ্তারের করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি আমরা।”
এর আগে সোমবার রাতে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার সাংবাদিকদের বলেন, “ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের ভয়ে তিনি দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। তবে আমাদের গোয়েন্দা ইউনিটের সদস্যরা তাঁর ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলেন। যে কারণে তিনি পালাতে পারেননি।”
সেলিম প্রধানের দুই কার্যালয় থেকে ৪৮টি বিদেশি মদের বোতল এবং দুটি হরিণের চামড়াও উদ্ধার করা হয়েছে। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে অর্থপাচার প্রতিরোধ ও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনের পাশাপাশি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে মোট চারটি মামলা করার কথা জানিয়েছে র্যাব।
গুলশান থেকে সেলিমের প্রধান সহযোগী মোহাম্মদ আখতারুজ্জামানকেও গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
ব্যবসায়িক গোষ্ঠী প্রধান গ্রুপের কর্ণধার সেলিমের প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস লিমিটেড, পি২৪ ল ফার্ম, এইউ এন্টারটেইনমেন্ট, পি২৪ গেমিং, প্রধান হাউস ও প্রধান ম্যাগাজিন।
এর মধ্যে পি২৪ গেমিংয়ের মাধ্যমে তিনি জুয়াড়িদের অনলাইন ক্যাসিনোয় যুক্ত করতেন। ওয়েবসাইটে এই প্রতিষ্ঠানটির গুলশান-২ এলাকার দুটি এবং থাইল্যান্ডের চনবুন এলাকার একটি অফিসের ঠিকানা দেওয়া রয়েছে।
র্যাবকে যা বলেছেন সেলিম
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে সেলিম জানান, তাঁর জন্ম ১৯৭৩ সালে ঢাকাতে। ভাইয়ের হাত ধরে ১৯৮৮ সালে জাপানে চলে যান তিনি। সেখানে জাপানিদের সাথে গাড়ির ব্যবসা শুরু করেন।
পরবর্তীতে সেই জাপানিদের সাথেই তিনি থাইল্যান্ডে গিয়ে জাহাজ ভাঙার ব্যবসায় যোগ দেন। তাদের মাধ্যমেই ‘মিস্টার দ্যু’ নামের উত্তর কোরিয়ার এক ব্যক্তির সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি ঠিকাদারী ব্যবসায় বিনিয়োগের কথা বলে সেলিমের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাঁকে বাংলাদেশে একটি অনলাইন ক্যাসিনো চালুর প্রস্তাব দেন।
“যারই ধারাবাহিকতায় সেলিম ২০১৮ সালে ‘পি-টুয়েন্টিফোর’ এবং ‘টি-টুয়েন্টিওয়ান’ নামে দুটি গেমিং সাইট খোলে। যেখান থেকে সে অনলাইন কেসিনো পরিচালনা করছিল,” বলেন র্যাবের মুখপাত্র।
র্যাব তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক নথি পর্যালোচনা করেছে, কোরিয়ান ব্যবসায়ীর সাথে যৌথ মালিকানার চুক্তিপত্রও পেয়েছে। প্রধান গ্রুপের ওয়েবসাইটেও লেখা রয়েছে তারা বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনোর অন্যতম প্রবর্তক।
এশিয়ার ‘লাইভ ক্যাসিনো মার্কেটে’ এক নম্বরে যাওয়ার চেষ্টায় থাকার কথাও সাইটে উল্লেখ করেছে তারা।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বলেন, “এটি মূলত ভার্চুয়াল কেসিনো। যে ধরনের ক্যাসিনো মাঠে দেখা যায়, এখানে সেটি রয়েছে মোবাইলের মধ্যে আর খেলা হয় সফটওয়্যারের মাধ্যমে।”
“বিভিন্ন ধরনের গেমস এর তথ্য-উপাত্ত আমরা পেয়েছি। যার প্রতিটি টাকা দিয়ে খেলতে হয়। কীভাবে সদস্য হতে হবে বা খেলতে হবে, ওয়েবসাইটে তা সুস্পষ্টভাবে বাংলা ভাষায় বর্ণণা করা রয়েছে,” যোগ করেন তিনি।
মোবাইলে ‘পি-টুয়েন্টিফোর’ এবং ‘টি-টুয়েন্টিওয়ান’ সফটওয়্যার চালু করে নিজস্ব হিসাব খুলে ‘গেইমগুলো’ খেলতে হয়। বিকাশ, নগদের মতো মোবাইল ব্যাকিং সেবা এবং ভিসা অথবা মাস্টার কার্ডের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পরিশোধের পর খেলায় অংশ নেওয়া যায়।
সেলিমের রাজনৈতিক সংযোগ
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, “সেলিম প্রধান কিছুদিন আগেও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। সেই সূত্রে তাঁকে তিনি বিএমডব্লিউ গাড়িও উপহার দিয়েছিল বলে আমাদের বলেছেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি লন্ডনে অর্থ পাঠিয়েছেন বলেও প্রাথমিক স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন।”
প্রসঙ্গত, বর্তমানে কারান্তরীণ ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুন লন্ডনে অবস্থানকারী বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও ঘনিষ্ট বন্ধু।