বিচারক অপসারণের ক্ষমতা হারাল জাতীয় সংসদ

জেসমিন পাপড়ি
2017.07.03
ঢাকা
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন। জুলাই ০২, ২০১৭।
জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ

সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে সংবিধানে যে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, সেটি অবৈধ ঘোষণার রায় বহাল রেখেছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত। এর ফলে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে আবারও বিচার বিভাগের হাতে ফিরল।

গতকাল সোমবার হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ‘সর্বসম্মতভাবে’ খারিজ করে দেয় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ। সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনান প্রধান বিচারপতি।

এ রায়ে হতাশা প্রকাশ করে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সরকারপক্ষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে গতকাল রবিবার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় মন্ত্রীদের অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করেন।

সরকারি দল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ সাংবাদিকদের বলেন, এই রায়ে জাতি হতাশ হয়েছে।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের আশা ছিল সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ ৯৬ তে আবার ফিরে যাব। এই রায়ের ফলে সেটা আর হলো না। আমি ভীষণ হতাশ এবং অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করছি।”

তাঁর মতে, সংসদ যে সংবিধান বাতিল করেছে তা আপনা-আপনি পুনর্বহাল হবে না। এমন পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা বিরাজ করছে।

তবে সে বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে এ রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ ও প্রত্যাশিত বলে মত দিয়েছেন আইনজ্ঞরা।

প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম বেনারকে বলেন, “এর মাধ্যমে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ নেই। এই রায়ের মাধ্যমে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় আগের অবস্থা অর্থাৎ সুপ্রিম জুডিশিয়াল ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।”

সুপ্রিম কোর্ট ভবন। জুন ২৫, ২০১৭।
সুপ্রিম কোর্ট ভবন। জুন ২৫, ২০১৭।
জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ
এ রায় প্রত্যাশিত ছিল মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বেনারকে বলেন, “সংবিধানে বলা আছে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের কেউ কারও ওপর সরাসরি কর্তৃত্ব করবে না। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই নীতি লঙ্ঘিত হচ্ছিল। তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথককরণের স্বার্থে এই সংশোধনী বাতিল করা অত্যন্ত জরুরি ছিল।”

দেশের প্রথম সংবিধানে সংসদের হাতেই ছিল উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে বিচারক অপসারণের সে ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। হঠাৎ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সে বছরেই সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে গঠন করা হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল।

পরে আদালত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলে সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে। তবে তাতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এরপর ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, যার মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ।

সে বছর ৫ নভেম্বর ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী। হাইকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে গত বছরের ৫ মে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন। সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ বছরের ৮ মে শুরু হওয়া আপিলের শুনানি গত ১ জুন শেষ হয়।

এর আগে গত ৭ মার্চ গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির শুনানিতে ১২ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি (আইনি সহায়তাকারী) হিসেবে নিয়োগ দেন। এদের মধ্যে ১০ জন আদালতে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। তাঁদের মধ্যে ব্যরিস্টার আমির একজন।

দেশের সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম এই আইনজীবী বলেন, “১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারক নিয়োগের জন্য আইন করার কথা থাকলেও অর্ধশত বছরেও সেটা করা হয়নি। আশা করি সরকার আইনটি তৈরির পদক্ষেপ নেবে। দক্ষ ও যোগ্য বিচারক নিয়োগ হলে অপসারণের বিষয়টি গৌণ হয়ে যাবে।”

এ রায়ের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা। রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ সাংবাদিকদের বলেন, যেভাবে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, আইনজীবীরা এবং দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে, এ ক্ষেত্রে বিচারকেরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতেন না। ফলে এ দেশের জনগণ বিচার বিভাগের কাছ থেকে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হতো।”

তাঁর মতে, “ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বহাল থাকার এই রায় বাংলাদেশের ইতিহাসে, বিচার বিভাগের ইতিহাসে এবং জনগণের স্বার্থের পক্ষে এক ঐতিহাসিক রায়।”

পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষা সরকারের

এদিকে রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রশ্ন তুলেছেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন সংবিধান পরিপন্থী হয় কীভাবে?

সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকেরা রায়ের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে পূর্ণাঙ্গ রায় না পড়া পর্যন্ত মন্তব্য করতে রাজি হননি আইনমন্ত্রী। অবশ্য তৎক্ষণাৎ তিনি বলেন, “রায়ে ওনারা আপিল খারিজ করে দিয়েছেন। তবে আমার কাছে সব সময় প্রশ্ন থাকবে যে, ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে যেটা ছিল, সেটা কীভাবে সংবিধানের পরিপন্থী হয়—আমি সেটা বুঝতে পারছি না।”

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও সাংবাদিকদের জানান, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পরে আইন মন্ত্রণালয় ও সরকারের সঙ্গে আলাপ করে এই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হবে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বিএনপির অভিনন্দন

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া রায়কে ‘জনগণের বিজয়’ বলে অভিহিত করেছে বিএনপি। দলটি বলেছে, আদালতের এই সিদ্ধান্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।

গতকাল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের পক্ষে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, বিএনপি সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে স্বাগত ও অভিনন্দন জানায়।’

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।