করোনার ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতির মধ্যেই ডেঙ্গুর প্রকোপ, বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়

আহম্মদ ফয়েজ
2021.07.15
ঢাকা
করোনার ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতির মধ্যেই ডেঙ্গুর প্রকোপ, বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয় ঢাকার হাসপাতালের একটি দৃশ্য। ঢাকা। আগস্ট ১৮, ২০১৯।
বেনার নিউজ

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ও সংক্রমণের সংখ্যা যখন ক্রমেই রেকর্ড ভেঙে ঊর্ধ্বমুখী সেসময় জনমনে নতুন ভয়ের সৃষ্টি করছে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ। দুটিরই একই রকম উপসর্গ হওয়ায় প্রাথমিকভাবে যেমন আলাদা করা যাচ্ছে না, তেমনি রোগীদেরও গুনতে হচ্ছে বাড়তি খরচ।

চলতি জুলাই মাসে এসে ডেঙ্গু রোগী সনাক্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে কমপক্ষে দুইজন রোগীর মৃত্যুর ঘটনা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগেকে ভাবিয়ে তুলেছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য মতে, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘন্টায় দেশে ৮১জন ব্যাক্তি ডেঙ্গু সনাক্ত হওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এসব রোগীদের ৭৯জনই ঢাকায় এবং বাকি দুইজন ঢাকার বাহিরের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাঠানো বুলেটিনে বলা হয়েছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া দুইজন রোগী সম্পর্কে নিশ্চিত হতে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) তথ্য পাঠানো হয়েছে।

এতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা ৯৯৫, যাদের মধ্যে ৬৯০ জন সুস্থ্ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

বুলেটিনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩০৩ জন। যাদের মধ্যে ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগী ২৯৯ জন এবং বাকি চারজন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে।

এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলছে খোদ স্বাস্থ্য বিভাগ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর লাইন ডিরেক্টর ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বেনারকে বলেন, “কোভিডের মধ্যেই হঠাৎ করে যেভাবে রোগী বাড়তে শুরু করেছে তাতে এটা বলাই যায় যে, পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।”

“হঠাৎ করে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করেছে। গত মাসের তুলনায় এই মাসে রোগীর সংখ্যা অনেকগুনে বেড়েছে। এমনিতেই করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সামাল দিতে গিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছি, এর মধ্যে ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়াটা আমাদের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জি​ং,” যোগ করেন ডা. আমিন।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করছে যাতে পরিস্থিতি সহনশীল রাখা যায়।

“ডেঙ্গু চিকিৎসায় আমাদের দেশের চিকিৎসকেরা অভিজ্ঞ। পূর্বেও আমরা কঠোর পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছি,” বলেন সরকারের এই মূখপাত্র।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্বের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বেনারকে বলেন, “ডেঙ্গু ও করোনাভাইরাসের উপসর্গ প্রায় একই রকম হওয়ায় একটি জটিলতর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং এটি আরো প্রকট হবার সম্ভাবনা রয়েছে।”

তিনি বলেন, সাধারণত মানুষ জ্বরে আক্রান্ত হলে দুই–তিন দিন বাসাতেই অপেক্ষা করে এবং বোঝার চেষ্টা করে যে, এটা স্বাভাবিক জ্বর কিনা। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে হলেও এটি তেমন কোনও সমস্যা নয়। তবে এই জ্বর যদি ডেঙ্গু জ্বর হয়, তবে দুই–তিন দিনেই রোগীর অবস্থার অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

নাগরিকদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে জ্বর হলেই দ্রুত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে এটি ডেঙ্গু বা কোভিড কিনা।

তিনি বলেন, প্রতিটি জ্বরের ক্ষেত্রেই রোগীকে বেশ কয়েকটি টেস্ট করতে হচ্ছে যাতে সাধারণ মানের হাসপাতালেও প্রতি রোগীর প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।

“এই খরচ বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রচুর, কিন্তু এই মুহূর্তে এর কোনও বিকল্প নেই। খরচ কমাতে রোগীদের চেষ্টা করতে হবে সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা করানো যায় কিনা, সেক্ষেত্রে খরচ কমে আসবে,” বলেন বাশার।

করোনার মধ্যেই ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়ের কারণ হলেও সরকার সেই অর্থে প্রস্তুত বলে মনে করছেন না বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (​বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব।

তিনি বেনারকে বলেন, “সরকারের উচিত করোনা ও ডেঙ্গু রোগীদের আলাদা চিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে আইসিইউ সূবিধাসহ অন্তত তিনটি ডেডিকেটেড হাসপাতাল রাখা।”

তিনি বলেন, জ্বর নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীদের কোভিড ও ডেঙ্গু পরীক্ষা স্বল্পমূল্যে করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সর্বমোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৩৭১, আর শুধু জুলাই মাসের প্রথম ১৫ দিনে রোগীর সংখ্যা ৩৭১।

সরকারি হিসেবে, ২০১৯ সালে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন এবং মারা গেছেন ১৭৯ জন। ২০২০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১ হাজার ৩৯২ জন, মারা গেছেন তিনজন।

বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ধরা পড়ে ২০০০ সালে।

করোনায় মৃত্যু আরো ২২৬

দেশে বৃহস্পতিবার সকাল আটটা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ১৭ হাজার ২৭৮।

এই সময়ে করোনায় আক্রান্ত হিসেবে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন আরও ১২ হাজার ২৩৬ জন। এ নিয়ে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ১০ লাখ ৭১ হাজার ৭৭৪ জন।

১৮ বছর পার হলে টিকা

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, দেশের শিক্ষা কার্যক্রমকে আবার গতিশীল করতে ১৮ বছরের বেশি সব নাগরিককে ক্রমান্বয়ে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার মহাখালীর বিসিপিএস ভবনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড-১৯ আইসিইউ বেড সম্প্রসারণ ও আউট পেশেন্ট ডিপার্টমেন্ট উদ্বোধনকালে মন্ত্রী বলেন, বর্তমানে সরকারের হাতে ৪৫ লাখ ডোজ টিকা রয়েছে। গত ১৪ জুলাই থেকেই টিকা প্রদান কার্যক্রম পুরোদমে চালু হয়েছে।

তিনি বলেন, চীন থেকে আগেই ২০ লাখ ডোজ টিকা সরকার হাতে পেয়েছে। আরো দেড় কোটি টিকা প্রতি মাসে পর্যায়ক্রমে দেশে আসতে থাকবে। এর পাশাপাশি অ্যাস্ট্রেজেনেকার ২৯ লাখ ডোজ বরাদ্দ রয়েছে।

রোহিঙ্গাদের টিকার আওতায় আনবে সরকার

 শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন, কক্সবাজারে শরনার্থী শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার আন্তরিক।

 “কক্সবাজারের সিভিল সার্জন আমাকে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পর্যায়ক্রমে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা হবে,” বেনারকে বলেন আরআরআরসি শাহ রেজওয়ান হায়াত।

তিনি বলেন, আগামী আগস্ট মাসের মধ্যেই শরণার্থী ক্যাম্পে টিকাদান কর্মসূচী শুরু হবে এবং পর্যাক্রমে সবাইকে টিকার আওতায় আনা হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।