গ্রামমুখী জনস্রোতে সংক্রমণ এক দফা বাড়বে, আরেক দফা ঢাকায় ফিরলে
2021.07.19
ঢাকা

বিশেষজ্ঞদের মতামতের বিপক্ষে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার লকডাউন তুলে দিয়ে গণপরিবহন চলাচল করার অনুমতি দেয়ার প্রেক্ষাপটে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভেরিয়েন্ট বাংলাদেশে দ্রুতহারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার কথাই সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে।
লকডাউন প্রত্যাহারের পাঁচ দিনের মাথায় সোমবার বাংলাদেশে একদিনে রেকর্ড ২৩১ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং ১৩ হাজার ৩২১ জন করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ঈদ-উল-আজহা পালন করতে লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ার প্রেক্ষাপটে সংক্রমণ আরও বাড়বে। তাঁদের মতে, গাদাগাদি করে ঈদ পালনের জন্য ঢাকা থেকে গ্রামমুখী জনস্রোতে সংক্রমণ এক দফা বাড়বে এবং ঈদ পালন শেষে ঢাকায় ফেরার মাধ্যমে আরেক দফা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাবে।
করোনাভাইরাস সংক্রান্ত কারিগরি কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভঅগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সোমবার বেনারকে বলেন, “করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আমরা কারিগরি কমিটির পক্ষ থেকে ঈদ সামনে রেখে গণপরিবহন বন্ধ রাখতে বলেছিলাম। এর ফলে বেশি মানুষ ঢাকার বাইরে যেতে পারতেন না।”
তিনি বলেন, “লকডাউন তুলে দিয়ে গণপরিবহন উন্মুক্ত করে দেয়ার কারণেই সংক্রমণ প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। মানুষ গাদাগাদি করে শহর থেকে গ্রামে ছুটে যাচ্ছে।”
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, “আবার তাঁরা একইভাবে গাদাগাদি করে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে ফিরে আসবে এবং করোনার আরেকদফা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাবে। এই কারণেই আমরা গণপরিবহন বন্ধ রাখতে বলেছিলাম।”
তিনি বলেন, “সঠিক স্বাস্থ্যবিধি পালনের মাধ্যমে আমরা কোরবানীর পশুর হাট পরিচালনার কথা বলেছিলাম। কিন্তু পশুর হাটে হাজার হাজার মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কোরবানীর পশু কিনছেন। করোনা ছড়াচ্ছেন।”
অধ্যাপক নজরুল বলেন, “ডেল্টা ভেরিয়েন্ট খুবই সংক্রমণশীল। ভবিষ্যতে এই সংক্রমণ অনেক বেড়ে যাবে।”
প্রথমবারের মতো ঢাকার পরিবর্তে বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে গত পহেলা জুলাই থেকে দুই সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করে সরকার।
ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষ্যে শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে ভ্রমণের কারণে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কায় গণপরিবহন বন্ধ রাখার সুপারিশ করে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ সংক্রান্ত কারিগরি কমিটি।
তবে ঈদকে সামনে রেখে দোকানপাট ও গণপরিবহন খুলে দেয় সরকার। সরকার জানিয়েছে, ঈদের পর পুনরায় ১৫ দিনের কঠোর লকডাউন দেয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবিএম খুরশিদ আলম বেনারকে বলেন, “দেখুন কারিগরি কমিটির সদস্য যা বলেছেন সেটিও ভুল নয়। আবার সরকার যে লকডাউন তুলে নিয়েছে সেটিও ভুল সিদ্ধান্ত নয়। কারণ, সবদিক বিবেচনা করে আমরা লকডাউন শিথিল করেছি।”
তিনি বলেন, “আসলে টানা এক মাস লকডাউন দেয়ার মতো অবস্থা আমাদের দেশে নেই। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে আমরা লকডাউন শিথিল করেছি।”
মহাপরিচালক বলেন, “ব্যাপক আকারে টিকা দেয়া না হলে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হবে না। সেকারণে আমরা টিকা নেয়ার বয়স কমিয়ে ৩০ বছর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
তিনি বলেন, “আমরা তৈরি পোশাক শিল্পে নিয়োজিত কর্মী এবং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্রুত টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।”
তবে কোরবানীর পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হলেও ঢাকার কোনও পশুর হাটে সরকারি আদেশ মানা হয়নি বলে প্রত্যক্ষ করেছেন বেনারনিউজ প্রতিনিধি। সোমবার রাজধানীর আফতাবনগর গরুর হাটে সরেজমিন দেখা যায়, হাজার হাজার মানুষের ভিড়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার গরু এনেছেন সেখানে।
“এই হাজার হাজার মানুষ ও পশুর মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব নয়। এখান থেকেই প্রচুর মানুষ হয়তো করোনায় আক্রান্ত হবেন,” বেনারকে জানান এসএম শরিফ, যিনি তাঁর মালিকের জন্য গরু কিনতে গিয়েছিলেন।
এদিকে ট্রেন, বাস, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে স্বাস্থ্যবিধি সেভাবে মানা হচ্ছে না।
ঢাকায় চলাচলকারী বিহঙ্গ পরিবহনের হেলপার মো. হালিম বেনারকে বলেন, “স্বাস্থ্যবিধি মানলে পেট চলবো না। দুদিন পরে তো আবার লকডাউন। তখন কি করমু? করোনা হইলে হইবো। কিছু করার নাই। না খাইয়া মরুম না।”
গত বছর ৮ মার্চ বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। ১৮ মার্চ এই ভাইরাসে প্রথম মৃত্যু ঘটে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে কয়েক দফায় মে মাসের শেষ পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। বন্ধ করে দেয়া হয় প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু এই সাধারণ ছুটির কারণে দেশের দারিদ্র সীমা ব্যাপক বেড়ে যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এর এক জরিপে দেখা যায়, ২০২০ সালে ওই সাধারণ ছুটির কারণে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র বৃদ্ধি পেয়ে শতকরা ৪৫ ভাগে দাঁড়ায়।
ওই জরিপ অনুযায়ী, সেই সাধারণ ছুটির কারণে বাংলাদেশে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়।
এই প্রেক্ষাপটে জুন থেকে অর্থনীতি খুলে দেয়া হলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। রাস্তাঘাটে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমে আসে। অর্থনীতি খুলে দেয়ার ফলে গত বছরও জুন-জুলাই মাসে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ঘটে।
এরপর থেকে সংক্রমণ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। সংক্রমণ হার শতকরা ৩০ ভাগ থেকে নেমে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে শতকরা তিন ভাগের কমে নেমে আসে।
তবে মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ আবার বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর কারণ হিসাবে স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, এই দফায় সংক্রমণের জন্য দায়ী ভারতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ডেলটা ভেরিয়েন্ট।
গত কয়েকদিন ধরে সংক্রমণের হার শতকরা ৩০ ভাগ অথবা তার চেয়ে বেশি।