কোভিড টেস্টে প্রতারণা: ডা. সাবরিনাসহ আট আসামির ১১ বছর জেল
2022.07.19
ঢাকা

করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া প্রতিবেদন দেয়ার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারপারসন ডা. সাবরিনা চৌধুরী এবং তাঁর স্বামী ও প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আরিফুল হক চৌধুরীসহ আটজনকে ১১ বছর কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত।
মঙ্গলবার ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. তোফাজ্জল হোসেন আলোচিত মামলাটির রায় ঘোষণা করেন।
এই রায়ে একইসঙ্গে সব আসামিকে ১১ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আজাদ রহমান।
সাজাপ্রাপ্ত অপর আসামিরা হলেন; জিকেজি হেলথকেয়ারের কর্মী সাঈদ চৌধুরী, হুমায়ুন কবির ও তার স্ত্রী তানজীনা পাটোয়ারী, শফিকুল ইসলাম, প্রতিষ্ঠানটির ট্রেড লাইন্সেসের স্বত্ত্বাধিকারী জেবুন্নেছা রিমা, বিপ্লব দাস।
এর আগে গত ২৯ জুন এ মামলায় রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে ১৯ জুলাই রায়ের দিন ঠিক করা হয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আসামিদের অপরাধ প্রমাণিত, সবার উদ্দেশ্য ছিল একই, তাই সাজাও হয়েছে একইরকম।
মামলার তদন্ত শেষে গত বছরের ৫ আগস্ট আদালতে ডিবি পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী অভিযোগপত্র জমা দেন। এতে জেকেজি হেলথ কেয়ারের কম্পিউটারে এক হাজার ৯৮৫টি ভুয়া রিপোর্ট ও ৩৪টি ভুয়া সার্টিফিকেট জব্দের কথা বলা হয়েছে।
একই মাসে সাবরিনাসহ ৮ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত।
২০২০ সালের ২৩ জুন জেকেজির সিইও আরিফসহ পাঁচজনকে আটক করে তেজগাঁও থানা পুলিশ।
ওই ঘটনায় তেজগাঁও থানায় প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে পুলিশ বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০২০ সালের ২২ জুন জেকেজির সাবেক গ্রাফিক্স ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু ও তার স্ত্রী তানজীন পাটোয়ারীকে আটক করে পুলিশ।
হিরু স্বীকারোক্তি দিয়ে জানান, তিনি ভুয়া করোনা সার্টিফিকেটের ডিজাইন তৈরি করতেন, যার সাথে জেকেজি গ্রুপের লোকজন জড়িত। ওই তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ জেকেজির সিইও আরিফুলসহ চারজনকে আটক করে।
আইনজীবী আজাদ জানান, ডা. সাবরিনা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। তিনি আরিফের চতুর্থ স্ত্রী। তার প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী রাশিয়া ও লন্ডনে থাকেন। তৃতীয় স্ত্রীর সাথে তালাক হয়েছে আরিফের।
রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের সন্তোষ, আসামিরা হতাশ
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আজাদ বলেন, “আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি।”
তিনি বলেন, চতুর্থ স্ত্রী ডা. সাবরিনার কারণেই করোনার নমূনা সংগ্রহের কাজ পায় জেকেজি হেলথকেয়ার।
অপরদিকে রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে সাবরিনার আইনজীবী প্রণব কান্তি ভৌমিক আদালত প্রাঙ্গনে গণমাধ্যমকে বলেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, সাবরিনা এজাহারভুক্ত আসামি না হলেও তাঁকে ডেকে নিয়ে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
“সাবরিনার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর একটা অভিযোগও রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি,” দাবি প্রণবের।
জেকেজি হাতিয়ে নেয় ৮ কোটি টাকা
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে জানান, প্রথমে রাজধানীর তিতুমীর কলেজ মাঠে নমুনা সংগ্রহের বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ৪৪টি বুথ স্থাপন করেছিল জিকেজি।
এই প্রক্রিয়ায় নিজেরা মাঠকর্মী নিয়োগ দিয়ে ২৭ হাজার রোগীকে করোনা টেস্টের রিপোর্ট দেয়। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমূনা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ জনের রিপোর্ট প্রতিষ্ঠানটি জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করে। প্রতিটি সার্টিফিকেটের বিনিময়ে তারা ৫ হাজার টাকা করে নেয়।
জেকেজির গুলশানের অফিস থেকে ১৫ হাজার ৪৬০টি ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে এই দম্পতি আয় করেন প্রায় আট কোটি টাকা।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী একজন তেজগাঁও থানায় মামলা করেন। এরপর ২০২০ সালের ২৩ জুন আরিফুল হক চৌধুরীসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই বছরের ১২ জুলাই সাবরিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে শফিকুল ও জেবুন্নেসাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ।
রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে দুপুরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাবরিনা বলেন, “আল্লাহ ধৈর্যশীলের সাথে থাকেন। ধৈর্য রাখেন, প্রমাণ হবে। একদিন মানুষ জানবে সাবরিনা নিরপরাধ ছিল।”
আদালতের রায়ে হতাশা প্রকাশ করে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া এই সরকারি চিকিৎসক আরও বলেন, “আমি তো সেদিনই মরে গেছি যেদিন আমাকে কারাগারে ঢোকানো হয়েছে। আমি কারাগার থেকে বের হবো কিনা সেটা বড় কথা না। বড় কথা হলো-দেশের মানুষ জানলো আমি অপরাধী।”