টিকা প্রদান ও লকডাউন নিয়ে সমন্বয়হীনতা, বিরক্ত মানুষ

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.08.06
ঢাকা
টিকা প্রদান ও লকডাউন নিয়ে  সমন্বয়হীনতা, বিরক্ত মানুষ ঢাকার রাস্তায় একটি দৃশ্য। ঢাকা। আগস্ট ৫, ২০২১
বেনার নিউজ

লকডাউন কার্যকর করা ও টিকা প্রদানসহ সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা ও নীতি-আদেশের ঘন ঘন পরিবর্তনে বিরক্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে মানুষের মধ্যে মহামারি সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাসের টিকার বিষয়ে পরষ্পরবিরোধী বক্তব্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম শুক্রবার বলেছেন, এর সবটুকুর দায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের না।

তবে তিনি বলেন, “আপনারা দেখেছেন নানান জায়গা থেকে নানা মন্তব্য এসেছে। আমরা সে ব্যাপারগুলোর বিষয়ে সজাগ আছি। আমরা চেষ্টা করবো ভবিষ্যতে যাতে এর পুনরাবৃত্তি না হয়।”

রাজধানীর মহাখালীতে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইন নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মহাপরিচালক এ কথা বলেন। আগামীকাল ৭ আগস্ট থেকে ১২ আগস্ট দেশজুড়ে টিকা ক্যাম্পেইন করে ৩২ লাখ মানুষকে প্রথম ডোজ দেওয়ার কথা জানান তিনি।

 গণটিকা নিয়ে বারবার সিদ্ধান্ত বদল

 ঘন ঘন নীতি পরিবর্তনের আরেক উদাহরণ দেখা গেল শুক্রবারও। গত ২৭ জুলাই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ৭ আগস্ট থেকে সারাদেশে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হবে। কিন্তু বৃহস্পতিবার মহাপরিচালক এবিএম খুরশীদ আলম সাংবাদিকদের জানান, ৭ আগস্টের পরিবর্তে ১৪ আগস্ট শুরু হবে গণটিকা কার্যক্রম।

শুক্রবার তিনিই আবার জানালেন, পূর্ব ঘোষিত ৭ আগস্টেই পরিবর্তে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হবে। সারা দেশে সকল ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৩২ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া হবে বলে তিনি জানান।

টিকা কার্যক্রম পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জৈষ্ঠ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ.এস.এম. আলমগীর শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আমাদের গণটিকা কার্যক্রমের তারিখ কখনও পরিবর্তন করা হয়নি। বিভিন্ন বক্তব্যের কারণে জনগণের মধ্যে ভুল বার্তা গেছে। ইউনিয়ন পরিষদে একদিন চলবে। আর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় দুই থেকে তিন দিন চলবে।”

তিনি বলেন, “আমাদের হাতে ৫৫ লাখের মতো টিকা আছে। পরিকল্পনা মতো টিকা পাওয়া গেলে আগস্ট মাসের মধ্যে আমরা এক কোটি মানুষকে টিকা দিতে পারব। এর মধ্যে আরও টিকা আসলে আমরা ১৪ আগস্ট আরেক দফা গণটিকা কার্যক্রম শুরু করা হবে।”

টিকার বয়স নিয়ে বিভ্রান্তি

বাংলাদেশে টিকা কার্যক্রম শুরু হয় ২৭ জানুয়ারি। তখন টিকা নেয়ার সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারণ করা হয় ৪৫ বছর। এরপর ধাপে ধাপে এই বয়স কমিয়ে প্রথমে ৪০ বছর, এরপর ৩৫ বছর এবং ৩০ বছর করা হয়।

২৪ জুলাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের জানান, করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা করতে টিকা কার্যক্রমের গতি বাড়াতে সরকার টিকা নেয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছরে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুই দিন পর এই সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছরের পরিবের্ত ২৫ বছর করা হয়।

টিকা নেওয়ার বয়সসীমা ১৮ থেকে কেন আবার ২৫ বছর করা হলো জানতে চাইলে শুক্রবার স্বাস্থ্যের মহাপরিচালক বলেন, “১৮ বছর বয়সী অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, পরিচয়পত্র ছাড়া ১৮ বছর বয়সীদের টিকার আওতায় আনতে গেলে মাঠের বিশৃঙ্খলা সামাল দেওয়া যাবে না।’

 লকডাউন নিয়ে যা কিছু

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে ৫ এপ্রিল থেকে ২৪ মে পর্যন্ত প্রথম লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। তবে কলকারখানা বন্ধ রাখা হয়নি।

এরপর ১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই আরেক দফা লকডাউন কার্যকর করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতামতের বিপরীতে গিয়ে ঈদ উপলক্ষে খুলে দেওয়া হয় গণপরিবহনসহ সবকিছু। স্থাপন করা হয় কোরবানীর পশুর হাট।

ঈদ শেষে ২৩ জুলাই থেকে আবার লকডাউন কার্যকর করা হয়। বন্ধ করা হয় সকল কল-কারখানা। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ব্যবসায়ীদের জানিয়ে দেন, কারখানা খোলার রাখার ব্যাপারে তাদের অনুরোধ রাখা সম্ভব নয়।

কিন্তু ২৯ জুলাই ব্যবসায়ী নেতারা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সাথে দেখা করে কারখানা খুলে দেয়ার দাবি জানান। ৩০ জুলাই এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১ আগস্ট থেকে রপ্তানিমুখী কারখানা খুলে দেয় সরকার। মাত্র একদিনের নোটিশে এবং গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ঢাকায় আসতে বিড়ম্বনা ও হয়রানির মুখে পড়েন শ্রমিকেরা।

মন্ত্রীদের বক্তব্য নিয়ে বিভ্রান্তি

গত মঙ্গলবার করোনাভাইরাস সংক্রমণ সম্পর্কিত পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক সভা শেষে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের জানান, মাস্ক ছাড়া কেউ বাইরে গেলে অথবা টিকা না নেয়া ১৮ বছরের বয়সের বেশি কোন নাগরিক বাইরে গেলে শাস্তি পেতে হবে।

পরদিন বুধবার তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রীর বক্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত হতে পারে; তবে সরকারের নয়। এর কিছুক্ষণ পর সংবাদ সম্মেলন করে নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করেন মন্ত্রী মোজাম্মেল হক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “এই মহামারি মোকাবিলায় সরকারি পদক্ষেপগুলোর মধ্যে কোনও সঙ্গতি নেই। এতে মানুষ বিভ্রান্তির মধ্যে আছে।”

তিনি বলেন, “কারিগরি কমিটি এক কথা বলে, সরকার আরেক কাজ করে। আমরা বুঝি সরকারকে সবদিক সামলে কাজ করতে হয়। তাই বলে এত অসঙ্গতি কাম্য নয়।”

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক আহমেদ বেনারকে বলেন, “করোনা মহামারির মধ্যে সরকারের উচিত ছিল একজন ব্যক্তি অথবা মুখপাত্র ঠিক করা যিনি সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে কথা বলবেন। কিন্তু সেটি প্রথম দিকে থাকলেও পরে তা রক্ষা করা হয়নি। বিভিন্ন ব্যক্তি ও কর্মকর্তারা একেক সময়ে একেকরকম বক্তব্য দিয়েছেন।”

“এর ফলে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বিভিন্ন রকমের বার্তা গেছে জনগণের কাছে। জনগণ বিভ্রান্ত হয়েছেন,” তিনি যোগ করেন।

ডা. মোশতাক বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এই মাসে এক কোটি টিকা দেয়া হবে শনিবার থেকে। আবার আজকে শোনা যাচ্ছে সেটি ১৪ আগস্ট থেকে শুরু হবে। আমার মনে হয়, সরকারের উচিত একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে টিকা কর্মসূচী প্রণয়ন করা।”

তিনি বলেন, “সরকারের হাতে বর্তমানে এক কোটি টিকা থাকলে তো এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়া যাবে না; ৫০ লাখ মানুষকে দেয়া যাবে। সুতরাং, এক কোটি মানুষকে দেয়ার মতো টিকা হাতে পাওয়ার পর এই কর্মসূচী সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে হবে।”

মিরপুরে একটি আন্তর্জাতিক ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত কর্মচারী মো. আরিফ হোসেন বেনারকে বলেন, “করোনা মহামারিতে সরকার যেভাবে লকডাউন দিয়েছে সেটি ঠিক হয়নি। একবার বলে লকডাউন, কিছু চলবে না। আবার দুদিন পর বলে শিথিল করা হলো, দোকানপাট সীমিত সময়ের জন্য খুলে দেয়া হলো। ফলে লকডাউনকে আর মানুষ গ্রহণ করছে না।”

তিনি বলেন, “লকডাউন যদি করতে হয় তাহলে কঠোরভাবে করতে হবে। কঠোরভাবে করা হলে জনগণের কষ্ট হলেও মানুষ তা মানবে।”

আরিফ বলেন, “এভাবে বার বার শিথিল করার ফলে সাধারণ মানুষ রাজধানী থেকে সারাদেশে চলাচল করছে, এবং তাতে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।”

করোনায় জিডিপি প্রসঙ্গ

করোনা মহামারি দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলেলেও সেই তথ্য প্রকাশ করছিল না সরকার। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চুড়ান্ত হিসাবে বলা হয়েছে, মহামারির কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ, ​যদিও গত জুনে বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তাফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থ বছরের সাময়িক হিসাবে প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছিলেন ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। অর্থনীতিবিদেরা এই সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আসছিলেন।

“দেরিতে হলেও বিবিএস অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে চিত্র প্রকাশ করেছে তা বাস্তবতার খুব কাছাকাছি। আমরা আগেই হিসাব করে বলেছিলাম অতিমারির অভিঘাতে প্রবৃদ্ধিতে টান পড়বে যা ২ দশমিক ৩ শতাংশের বেশি হবে না,” বেনারকে বলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মাণিত ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান।

“২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষভাগে এসে মহামারির কারণে অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা প্রায় থেমে গিয়েছিল। সুতরং ওই বছরের সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে এর প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক,” বলেন তিনি।

এদিকে শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে গত ২৪ ঘন্টায় করোনাভাইরাসে রেকর্ড ২৪৮ প্রাণহানি ঘটেছে। এই নিয়ে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের কারণে ২২ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে।

গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ১২ হাজার ৬০৬ জন। এ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছে ১৩ লাখের বেশি মানুষ।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন পুলক ঘটক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।