করোনাযুদ্ধে কেউ লড়ছে, কেউবা দোয়া চাচ্ছে, কেউ কেউ পালাচ্ছে
2021.07.08
ঢাকা

সাংবাদিক বোরহানুল হক সম্রাট তাঁর ফেসবুকে একটি সম্মতিপত্রের কপি তুলে দিয়ে লিখেছেন, “রহম করো মালিক।” করোনা আক্রান্ত মাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়ার আগে তিনি এই সম্মতিপত্রে সই দেন।
সম্রাটের বাবাও করোনা আক্রান্ত হয়ে একই হাসপাতালে স্টেপ ডাউন ইউনিটে (এসডিইউ) ভর্তি। এই তথ্য জানিয়ে ৭ জুলাই সম্রাট লিখেছেন, “কে আগে ডাকবে আমাকে। জননী না জনক, কার কাছে ছুটে যাবো কোন আশা নিয়ে। আল্লাহ তুমি সব জানো।”
এর আগে সম্রাট নিজেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এমনকি গত বছরের ১৬ জুন তাঁর স্ত্রী যখন করোনা আক্রান্ত হন, তখন তাদের একমাত্র পূত্র সুহৃদ ছিল মায়ের গর্ভে।
করোনায় সপরিবারে আক্রান্ত হওয়ার হাজার হাজার ঘটনা রয়েছে শহর থেকে গ্রামে। সম্রাট তাঁর অন্য স্বজনদের নিয়ে অন্তত মা–বাবার সেবা করতে পারছেন। কিন্তু এমন অনেক পরিবার রয়েছে, যাদের দেখভাল করারও কেউ নেই।
রাজধানীর মালিবাগের বাসিন্দা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ৬৯ বছর বয়সী জহুরুল ইসলামের (ছদ্মনাম) করোনা সনাক্ত হয় গত ১ জুলাই। পরদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা যায়, ফুসফুসের ৩৫ শতাংশ প্রায় অকেজো হয়ে গেছে।
গত ৩ জুলাই মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ভর্তি করা হয় তাঁকে। ৫ জুলাই তাঁর স্ত্রী রাহেলা বেগমের (ছদ্মনাম) করোনা সনাক্ত হয়।
এই নিঃসন্তান দম্পতি বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান, তারা এর আগে কখনো এতটা অসহায় বোধ করেননি।
“নিজেদের সন্তান নেই, আত্মীয়-স্বজনেরাও দেখতে আসতে পারছে না। তারাও ভয় পাচ্ছে এবং এটা স্বাভাবিক ধরে নিয়ে আমরা দুজন একই কেবিনে করোনার িবরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছি,” মুঠোফোনে বেনারকে বলেন রাহেলা।
“আমাদের কারও শ্বাসকষ্ট হয়নি এখনো। তবে হাসপাতালে যে চিত্র দেখছি, তাতে দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছি না,” যোগ করেন তিনি।
এভাবে স্বামী–স্ত্রী একসঙ্গে করোনার সঙ্গে লড়ার চিত্র যেমন আছে, তেমনি স্ত্রী মারা যাওয়ার পর স্বামীর পালিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে বৃহস্পতিবার। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত স্ত্রীকে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়া ওই ব্যক্তিটিকে খুঁজে পায়নি পুলিশ।
স্বজনদের কেউ না আসায় মর্গ থেকে নিয়ে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন মরদেহ দাফন করেছে।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালের করোনা ইউনিটে বৃহস্পতিবার ভোরে মারা যায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত নগরীর ডবলমুরিং থানাধীন মৌলভিপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোজাম্মেল হকের স্ত্রী আসমা আক্তার (৩৮)। গত মঙ্গলবার মোজাম্মেল তার স্ত্রীকে সেখানে ভর্তি করিয়েছিল।
চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জহিরুল হক ভুইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর বুধবার দুপুর থেকেই লাপাত্তা রয়েছেন স্বামী। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের কর্মীরা স্ত্রীর লাশ দাফন করেছে।
মৃত্যুর রেকর্ডের পরদিন সংক্রমণে রেকর্ড
বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৩৮ হাজার নমুনা পরীক্ষা করে আরও ১১ হাজার ৬৫১ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এসময় মৃত্যু হয়েছে ১৯৯ জনের। বুধবার মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২০১, যা এ যাবৎকালের রেকর্ড।
ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে গত ৩০ জুন থেকে শুরু হওয়া কঠোর লকডাউন চলছে, যা চলবে ১৪ জুলাই পর্যন্ত।
নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ৯ লাখ ৮৯ হাজার ২১৯ জনে। তাদের মধ্যে ১৫ হাজার ৭৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনাভাইরাসে। গত ২৪ ঘন্টায় মারা যাওয়া ১৯৯ জনের মধ্যে ৬৫ জনই ছিলেন ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা। খুলনা বিভাগে মৃত্যু হয়েছে ৫৫ জনের।
উৎকন্ঠা অক্সিজেন নিয়ে
গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এমন অবস্থায় অব্যহত থাকলে দেশে অক্সিজেন সঙ্কট দেখা দিতে পারে বলে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বুধবার ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশে ৫০ থেকে ৭০ মেট্রিক টন অক্সিজেনের চাহিদা থাকে। করোনাকালে সেটি আড়াই থেকে তিন গুণ বেড়েছে।”
“রোগীর সংখ্যা যদি এভাবে বাড়তে থাকে তাহলে সেটি সামাল দেওয়া আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে,” বলেন তিনি।
করোনা সংক্রমণের উর্ধ্বমুখী পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে ফিল্ড হাসপাতাল করা ও করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো ও জনবল পুনর্বন্টন করা হচ্ছে বলে জানান ডা. নাজমুল।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম এইচ চৌধুরী লেলিন বেনারকে বলেন, “অক্সিজেন উৎপাদন, তা সঠিকভাবে হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করা এবং রোগীদের শরীরে দেওয়ার উপকরণগুলোর সাথে যুক্ত করা; প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।”
দেশের ৩৫টি জেলায় আইসিইউ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, এসব জেলায় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ না থাকায় সেখানে হাই ফ্লো নজেল ক্যানেলা বসানো বা উচ্চ মাত্রার অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব নয়।”
ডা. লেলিন বলেন, “দেশের অনেক জায়গায় অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিল করতে হয়। কিন্তু রিফিলের জায়গা থেকে অক্সিজেন ব্যবহারের জায়গা বেশ দূরে। আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকঘণ্টা দেরি হয়। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দেয়।”
“যত করোনা রোগী বাড়বে, অক্সিজেনের চাহিদাও বাড়বে। অথচ দেশে এখনই অক্সিজেনের সুষম সরবরাহ ও বিতরণ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক হাসপাতালে রোগীদের অক্সিজেন দেওয়ার জন্য থাকা উপকরণগুলো কাজে লাগানো যাচ্ছে না,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “করোনার ভয়াবহতা আরো বাড়লে যে পরিমাণ অক্সিজেন দরকার হবে তা উৎপাদনের সক্ষমতা আমাদের নেই। ফলে অবধারিতভাবে অক্সিজেনের সঙ্কট দেখা দেবে। এই সঙ্কট মেটাতে দেশের বাইরে থেকে অক্সিজেন আমদানির আয়োজনও এখনই করে রাখা দরকার।”
অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর নির্দেশ
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা–বাসস জানায়, সংক্রমণ ও মৃত্যু হার বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও) কোভিড-১৯ রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ ও শয্যা সংখ্যা বাড়ানোসহ বেশ কিছু নির্দেশনা জারি করেছে।
পিএমও’র প্রেস উইং সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষকে সকলের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি কঠোরভাবে নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, আক্রান্তরা কেউ যেন বাড়ির বাইরে আসতে না পারে এবং প্রয়োজনে তাদের পৃথকীকরণ নিশ্চিত করতে হবে।
করোনাভাইরাস যাতে আরো ব্যাপকভাবে ছড়াতে না পারে সেজন্য দেশবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি ও স্বাস্থ্যনির্দেশনাগুলো মেনে চলার জন্যও পিএমও থেকে আহ্বান জানানো হয়।
জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার উপায় খুঁজে বের করার জন্য এবং কোভিড-১৯ সংক্রমণের বিরুদ্ধে চলমান সরকারি কার্যক্রমের সমন্বয় সাধনের জন্য বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসকদের সাথে অনুষ্ঠিত জরুরি বৈঠক থেকে এই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস পিএমও থেকে বৈঠকটিতে সভাপতিত্ব করেন।