বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে ১৩০ কোটি ডলার চুরি প্রচেষ্টার দায়ে যুক্তরাষ্ট্রে তিন উত্তর কোরীয় গোয়েন্দা অভিযুক্ত
2021.02.18
ওয়াশিংটন ডিসি

সাইবার হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১৩০ কোটি ডলার চুরি প্রচেষ্টার দায়ে উত্তর কোরিয়ার তিন গোয়েন্দাকে অভিযুক্ত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
উত্তর কোরিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ওই তিন সদস্য জন চ্যাং হিউক (৩১), কিম ইল (২৭) এবং পার্ক জিন হিউক (৩৬) এখন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায়। এই তিন ব্যক্তিই ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দশ কোটি (১০০ মিলিয়ন) ডলার চুরি করেছিল বলে বুধবার জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, “এই হ্যাকাররা অনলাইন লেনদেন কাঠামোতে সংযুক্ত ব্যাংক এবং অনলাইন মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সংস্থাগুলোর সিস্টেমে প্রবেশ করে ১.৩ বিলিয়ন (১৩০ কোটি) ডলার চুরির চেষ্টা করেছিল।”
“হ্যাকাররা বাংলাদেশ, মাল্টা, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, পোল্যান্ড, রিপাবলিক কোরিয়া, স্লোভেনিয়া, তাইওয়ান, যুক্তরাজ্য, ভিয়েতনাম, মধ্য আমেরিকা এবং আফ্রিকাসহ বিশ্বজুড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের হ্যাক এবং প্রতারণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষত ক্যালিফোর্নিয়ায় কেন্দ্রীয় জেলা তাঁদের টার্গেটের শিকার হয়েছে,” বলা হয় অভিযোগে।
ওই তিন আসামির মধ্যে পার্ক জিন হিয়োককে ২০১৮ সালে একটি অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।
এফবিআই’র উপ-পরিচালক পল অ্যাবেট এক বিবৃতিতে বলেছেন, “উত্তর কোরিয়ার সরকার কর্তৃক ২০১৮ সালে সম্পাদিত অভাবনীয় সাইবার আক্রমণের সঙ্গে আজকের নতুন অভিযোগটি যুক্ত হলো।"
উত্তর কোরিয়ার রিকনোসায়েন্স জেনারেল ব্যুরোর ইউনিটে কর্মরত উক্ত তিন হ্যাকার এই ষড়যন্ত্র কার্যকর করার সময় চীন ও রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করেছিল এবং সেসব দেশে অবস্থান করে ওই কাজ করেছিল, অভিযোগে বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় ৯৫১ বিলিয়ন ডলার সরানোর চেষ্টা করেছিল, এর মধ্যে ফিলিপাইনের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট ৮১ মিলিয়ন এবং শ্রীলঙ্কার একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২০ মিলিয়ন ডলার স্থানান্তর করেছিল।
অভিযোগ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ছাড়াও ওই হ্যাকাররা যেসব দেশের প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ চুরি করেছিল তার মধ্যে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনাম।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ভিয়েতনামের একটি ব্যাংক থেকে হ্যাকাররা জালিয়াতির মাধ্যমে ২৪ লাখ ইউরো বুলগেরিয়া এবং স্লোভেনিয়ার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নিয়েছিল।
২০১৭ সালের অক্টোবরে তাইওয়ানের ফার ইস্টার্ন ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের টার্গেটের শিকার হয়েছিল। তাইপেইর ওই ব্যাংক থেকে প্রায় ছয় কোটি ডলার হ্যাকাররা শ্রীলঙ্কা, কম্বোডিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেছিল।
এছাড়া ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা ইন্দোনেশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ২৪.৯ মিলিয়ন ডলার সরিয়েছিল বলেও জানানো হয় অভিযোগে।
এতে বলা হয়, সমুদ্র জাহাজের শেয়ার কেনাবেচার কাজে ব্যবহৃত “মেরিন চেইন টোকেন” নামে একটি ডিজিটাল টোকেন ব্যবহার করে হ্যাকাররা হংকংয়ের শেয়ারবাজার থেকে প্রতারণামূলকভাবে অর্থ সরানোর চেষ্টা করেছিল।
হ্যাকাররা কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান এবং থাইল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে টাকা না করলেও তারা সেখানকার অ্যাকাউন্টগুলোতে তহবিল স্থানান্তর করেছিল, যার ফলে অন্তত একটি দ্বিপক্ষীয় বিতর্ক তৈরি করেছিল।
বাংলাদেশ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফিলিপাইনের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলায় বলা হয়, ফিলিপাইনের ব্যাংকাররা উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের সাথে চক্রান্তে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চুরি করা ৮১ বিলিয়ন ডলার ফিলিপিন ব্যাঙ্কে স্থানান্তর করেছিল।
মামলাটিতে বলা হয়েছে, ফিলিপাইনের রিজাল বাণিজ্যিক ব্যাংকিং কর্পোরেশন (আরসিবিসি) তাদের আট কর্মকর্তার সাথে ক্যাসিনো পরিচালক, চীনা নাগরিক এবং হ্যাকারদের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল লুট করার ষড়যন্ত্রমূলক কাজে যুক্ত ছিল।
নিউইয়র্কে দায়ের করা বাংলাদেশ সরকারের মামলায় বলা হয়, “উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা ফিলিপাইনে তাদের সহ-ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে জোটবদ্ধ; যাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আরসিবিসি। ষড়যন্ত্রকারীরা ফেডারেল রিজার্ভ থেকে প্রতারণামূলকভাবে অর্থ উত্তোলনের জন্য আরসিবিসির নিউইয়র্ক সিটির করেসপনডেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছিল।”
যুক্তরাষ্ট্র বিচার বিভাগের জাতীয় সুরক্ষা বিভাগের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জন সি ডেমারসের বর্ণনায়, আমেরিকার কুখ্যাত ব্যাংক ডাকাত জন ডিলিংয়ের ব্যবহৃত পদ্ধতি থেকে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের কৌশল বেশ ভিন্ন।
“উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা বন্দুকের বদলে কীবোর্ড ব্যবহার করে। বিশ্বের এই শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক ডাকাতরা টাকার বস্তার পরিবর্তে ডিজিটাল অর্থ চুরি করে,” এক বিবৃতিতে বলেন ডেমারস।