দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত উপজেলা ও ইউপির দুই চেয়ারম্যান
2018.05.03
ঢাকা

বাংলাদেশে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এক উপজেলা পরিষদ ও আরেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে। রাঙ্গামাটি ও নরসিংদী জেলায় বৃহস্পতিবার মাত্র আড়াই ঘণ্টার ব্যবধানে এ দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। নিহত দুই চেয়ারম্যানই চলন্ত মোটর-সাইকেলে ছিলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সংস্কারপন্থী (এমএন লারমা) গ্রুপের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে (৫২) বেলা ১১টার দিকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
অন্যদিকে দুপুর দেড়টার দিকে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা বাঁশগাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সিরাজুল হককে (৬৪) হত্যা করা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বেনারকে জানান, দুটি হত্যাকাণ্ডই আধিপত্য বিস্তারজনিত পুরোনো শত্রুতার জেরে ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে আন্তদলীয় ও অন্তর্দলীয় কোন্দল, এ দুটোই খুব প্রবল হয়। এবার এটা আরও বেশি হবে বলে মনে হচ্ছে।”
নানিয়ারচরের ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে রাঙ্গামাটি জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) আলমগীর কবির বেনারকে বলেন, “আমরা হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।”
সন্দেহের তীর ইউপিডিএ’র দিকেই
শক্তিমান হত্যাকাণ্ডের পরপরই জেএসএস-সংস্কারের কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা এ ঘটনার জন্য ইউপিডিএফ’কে দায়ী করেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “ইউপিডিএফ’র সশস্ত্র গ্রুপের নেতা অর্পণ চাকমার নেতৃত্বে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।”
সংগঠনের সহ-তথ্য ও প্রচার সম্পাদক প্রশান্ত চাকমাও সাংবাদিকদের একই কথা বলেন।
তবে পার্বত্য শান্তি চুক্তি বিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে পরিচিত মাইকেল চাকমার অভিমত, “যাচাই না করে এভাবে অভিযোগ দিয়ে আসল হত্যাকারীদের বাঁচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
“জেএসএস-সংস্কারের নিহত ওই নেতার (শক্তিমান) সাথে নব্য মুখোশ নামে পরিচিত ইউপিডিএফ এর বিদ্রোহী গ্রুপ ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিকের সখ্যতা ছিল,” বেনারকে বলেন আদিবাসী নেতা দীপায়ন খীসা।
সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন আদি জেএসএস’র কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার বিভাগের সদস্য এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের এই তথ্য ও প্রচার সম্পাদক আরও বলেন, “দুই ইউপিডিএফ নেত্রীকে অপহরণ মামলারও অন্যতম আসামি ছিলেন শক্তিমান। যে কারণে এখন ইউপিডিএফ-কে সন্দেহ করা হচ্ছে।”
প্রসঙ্গত, গত ১৮ মার্চ রাঙ্গামাটির কুতুকছড়ি থেকে ইউপিডিএফ সমর্থিত হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই নেত্রী মন্টি চাকমা ও দয়া সোনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়। খাগড়াছড়ি সদরের মধুপুর এপিবিএন গেট এলাকায় ১৯ এপ্রিল তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
তৃতীয় পক্ষকে দুষছে অভিযুক্তরা
মাইকেল চাকমা বলেন, “যেভাবে এটা (শক্তিমান হত্যাকাণ্ড) ঘটল তাতে আমরা অবাক। নানিয়ারচরের চারদিকে পানি। তিনি (শক্তিমান) থানার একশ গজের মধ্যে খুন হয়েছেন। সেখান থেকে আর্মিদের এলাকাও বড়জোর আটশো গজ দূরে। এখানে খুন করে কেউ পালিয়ে যেতে পারে বলে আমার মনে হয় না।”
“ইউপিডিএফ ও জেএসএস-সংস্কারের মধ্যেকার দূরত্ব যাতে আরো সাংঘর্ষিক পর্যায়ে চলে যায়, সে উদ্দেশ্যে তৃতীয় পক্ষ এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে,” যোগ করেন তিনি।
দীপায়ন খীসা বেনারকে জানান, নিহত শক্তিমান চাকমার মতো জেএসএস-এমএন লারমা গ্রুপের সহায়তায় তৈরি হয়েছে ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক। তবে মাইকেল চাকমার দাবি, হত্যা, লুটপাট ও অরাজকতা তৈরির জন্য নব্য মুখোশদের ইদানীং আর সহ্য করতে পারতেন না শক্তিমান।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমগুলো জানায়, শক্তিমান চাকমা একজনকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ে যাচ্ছিলেন। উপজেলা সদরে পৌঁছানোর পর দুই সন্ত্রাসী তাঁকে গুলি করে পালিয়ে যায়।
স্থানীয় লোকজন দ্রুত উদ্ধার করে তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। গুলিবিদ্ধ হন তাঁর সঙ্গে থাকা একই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক রূপম চাকমা (৩৫)।
‘শক্তিমান চাকমার পোস্টমর্টেম চলছে। রাতেই তাঁকে দাহ করা হবে” বিকেলে বেনারকে বলেন এসপি আলমগীর। হত্যকারীদের চিহ্নিত ও গ্রেফতার করতে পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে বলেও তিনি জানান।
ডিসেম্বর থেকেই অস্থির পাহাড়
আঞ্চলিক দলগুলোর একাধিক নেতাসহ পার্বত্য তিন জেলার সাংবাদিকদের সাথে আলাপে জানা যায়, খুন, গুম, ধর্ষণ অপহরণসহ অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য অঞ্চল।
আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই বন্দুকযুদ্ধ ঘটছে, যার অধিকাংশের খবরই আঞ্চলিক ও জাতীয় গণমাধ্যমগুলোয় আসছে না।
মাইকেল চাকমা বেনারকে জানান, গত বছরের নভেম্বরে ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক আত্মপ্রকাশের পর ডিসেম্বর থেকেই পার্বত্য এলাকায় ফের অস্থিরতা শুরু হয়েছে। কারণ হিসাবে তিনিও আসন্ন নির্বাচনের কথা উল্লেখ করেন।
একমত দীপায়ন খীসাও, “পাহাড়ে সংঘাত বন্ধ থাকায় কোনো একপক্ষ খুশি নয়” জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে পাহাড়কে ঘিরে নানা রাজনৈতিক খেলাধুলা শুরু হয়।”
শক্তিমান চাকমা নিহত হওয়ার পর পুরো পার্বত্য এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। সহিংসতা এড়াতে পুলিশসহ স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের টহল বাড়ানো হয়েছে বলে সরকারি কর্মকর্তা বেনারকে জানান।
বাঁশগাড়িতেও উত্তেজনা চরমে
নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের জানান, ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা শেষে নিজের বাড়িতে ফিরছিলেন। তাঁকে বহনকারী মোটরসাইকেলটি আলী নগর আড়াকান্দা এলাকায় পৌঁছালে দুর্বৃত্তরা গতিরোধ করে।
তারা মোটরসাইকেল চালককে মারধর করে সরিয়ে দেয় এবং চেয়ারম্যানকে গুলি করে সড়কের পাশের জলাবদ্ধ জমিতে ফেলে দেয়।
আহত অবস্থায় চেয়ারম্যান সিরাজুল হককে প্রথমে রায়পুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “বাঁশগাড়ি ইউনিয়নের আধিপত্য নিয়ে অনেক আগে থেকেই দুটি পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। এরই জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি।”
পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তদন্ত শুরু করেছে বলেও তিনি জানান।
অন্যদিকে ইউনিয়নের জমাদ্দার বাড়িসহ ৮/১০টি বাড়িতে আগুন দিয়েছে নিহত চেয়ারম্যানের সমর্থকরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলেও ওসি বেনারকে জানান।