অনলাইনে নিরাপদ থাকার বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাচ্ছে ১০ হাজার স্কুলছাত্রী
2017.04.25
ঢাকা

বাংলাদেশে স্কুল পড়ুয়া ছাত্রীদের সাইবার সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। অনলাইনে নিরাপদ থাকার কৌশল না জানায়, প্রায়শ মেয়েরা বিপদে পড়ছে। মূলত, এই প্রেক্ষাপটেই দেশজুড়ে এমন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার। কর্মসূচিটির নাম ‘সাইবার সিকিউরিটি অ্যাওয়ারনেস ফর উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট’।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশে স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়রানির অভিযোগও বাড়ছে।
“বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধের শিকার মেয়েরা। কিন্তু মানমর্যাদাহানির আশঙ্কা থেকে পরিবারগুলো মামলা করতে চায় না। ফলে সারা দেশে কত নারী আসলে এ ধরনের অপরাধের শিকার হচ্ছেন তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান রাখা সম্ভব হয় না,” বেনারকে বলেন নাজমুল ইসলাম।
তবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির পরিসংখ্যান থেকে গত কয়েক বছরে অপরাধ প্রবণতা বাড়ার ধারণা পাওয়া যায়। সাইবার অপরাধ বিষয়ক মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে থাকে এই সংস্থাটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালে সিআইডি ২৫টি মামলার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মতামত দেয়। পরের বছর ২০১৪ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫টিতে, ২০১৫ সালে ২১৭টি এবং ২০১৬ সালে ৪১৬টি মামলায় মতামত দেয় সিআইডি। এ বছর প্রথম দুই মাসে এই সংখ্যা ছিল ৭৫।
যেভাবে হয়রানি
হয়রানির সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ হালের জনপ্রিয় তারকা সাবিলা নূর। গত ২৫ মার্চ থেকে সাবিলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিদেশি ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত একটি ভিডিওকে সাবিলা নূরের বলে চালানোর চেষ্টা হয়। কয়েক দিন পর ফেসবুকে হাজির হয়ে সাবিলা পুরো বিষয়টিকে অশ্লীল বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘এ রকম অশ্লীল বিষয়ে কথা বলতে রুচিতে বাঁধে।’
ভিডিওটি এখনো ওয়েবসাইটে আছে। তবে ভিডিওটি যে তাঁর নয় সে নিয়ে পত্রপত্রিকায় তাঁর মন্তব্য প্রকাশের পর এ নিয়ে আর আলোচনা এগোয়নি।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, অন্যের শরীরের ওপর মুখ বসিয়ে ছবি আপলোড করার অভিযোগ আসে। কখনো কখনো মেয়েরা বিশ্বাস করে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও শেয়ার করে ফেলে বন্ধুর সঙ্গে। বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেলে সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই রকম ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার নজির আছে।
এ রকম একটি সাম্প্রতিক ঘটনার উদাহরণ দিতে গিয়ে গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্রেফ কৌতূহল থেকে এবং ঠাট্টাচ্ছলে স্কুলের ওপরের দিকের ক্লাসে পড়া দুজন শিক্ষার্থী অন্তরঙ্গ মুহূর্তেও ভিডিও ধারণ করেছিল। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর ছেলেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ছড়িয়ে দেয়। ছেলেটি এখন কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে, মেয়েটি দেশ ছেড়ে চলে গেছে।
পুলিশ ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযোগ আসার দু-এক দিনের মধ্যে এ ধরনের ভিডিও কয়েক হাজারবার শেয়ার হয়ে যায়। ৷ ফলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে৷
কর্মসূচিতে যা থাকছে
প্রথমবারের মতো চালু হওয়া এই কর্মসূচির প্রথম পর্যায়ে আট বিভাগের মোট ৪০টি স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণির ১০ হাজার ছাত্রী প্রশিক্ষণে অংশ নেবে বলে জানান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের যুগ্ম সচিব আবুল মনসুর মো. শারফুদ্দিন।
“কর্মসূচির উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের জানানো তারা কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছে। তারা সাইবার আক্রমণের বা অপরাধের শিকার যেন না হয় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাবে। অপরাধের শিকার হলে মেয়েটি কোথায়, কার কাছে যাবে সে ব্যাপারেও এ কার্যক্রম থেকে জানবে ও প্রয়োগ করবে–এমনটাই আশা করা হচ্ছে,” আবুল মনসুর মো. শারফুদ্দিন বেনারকে বলেন।
তিনি আরও জানান পরীক্ষামূলকভাবে ৯৯৯ নম্বর চালু করা হয়েছে। সাইবার অপরাধের শিকার যে কেউ এই নম্বরে ফোন করলে সহযোগিতা পাবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের কর্মকর্তারা কর্মশালায় ছাত্রীদের ফেসবুক ও ই-মেইল আইডি সুরক্ষিত রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, ১২৩ বা এবিসিডি না দিয়ে কঠিন পাসওয়ার্ড দিতে হবে। কখনো কারো সঙ্গে ‘পাসওয়ার্ড' শেয়ার করা যাবে না৷ এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তিগত ছবি দেওয়ার ব্যাপারেও থাকতে হবে সতর্ক৷
দেশজুড়ে ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে খুলনার চারটি স্কুলের সাড়ে ৬শ শিক্ষার্থী সোমবার দিনব্যাপী এই প্রশিক্ষণটিতে অংশগ্রহণ করে। ইকবাল নগর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনিন্দিতা বিশ্বাস জানায়, ইন্টারনেটে কীভাবে নিরাপদ থাকা যায় জানা ছিল না। কর্মশালায় অংশ নিয়ে সে ব্যাপারে জানতে পেরেছে।
“আমরা আসলে প্রতি মুহূর্তেই দ্বিধায় পড়ি। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল বুঝতে পারি না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কতটুকু প্রকাশ করা যাবে, কতটুকু করা যাবে না জানতাম না। পরিষ্কার ধারণা হয়েছে এখন,” অনিন্দিতা বেনারকে জানায়।
একই স্কুলের তাসমিয়া মানহা বেনারকে বলেছে, বিপদে পড়লে সে চেপে যেত। এখন আর কথা গোপন করবে না। পরিবারকে জানাবে। আইনের আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন হলে তা–ও নেবে।
বিপদে পড়লে যে আইনের সুরক্ষা আছে কর্মশালায় সে কথাও জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর সাজার ব্যবস্থা আছে।
পাশপাশি, ফেসবুক ব্যবহার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সতর্কও করা হয়েছে প্রশিক্ষণে। শিক্ষার্থীদের জানানো হয়েছে, মিথ্যা ও অশ্লীল এমন কোনো কিছু ব্যবহার করা যাবে না, যা কোনো ব্যক্তি পড়ে, দেখে ও শুনে নীতিভ্রষ্ট হতে পারে।
জানতে চাইলে ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নাসিমা আক্তার বলেন পদক্ষেপটি সময়োপযোগী।
“আমার ছাত্রীরা ক্লাসে কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করে। তাদের ইন্টারনেটও ব্যবহার করতে হয়। অনেকে ফেসবুক ব্যবহার করছে। প্রশিক্ষণ থাকলে তারা নিরাপদ থাকবে,” বেনারকে নাসিমা আক্তার বলেন।