সাইবার বুলিং বন্ধে সারা দেশে কাজ করতে চান নড়াইলের কিশোর সাদাত

শরীফ খিয়াম
2020.11.18
ঢাকা
201118_Sadat_Final_1000.jpg নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরষ্কারের পদক হাতে বাংলাদেশের কিশোর সাদাত রহমান। ১৩ নভেম্বর ২০২০।
[কিডসরাইটস ইন্টারন্যাশনাল পিস প্রাইজ অ্যাওয়ার্ড/এএফপি]

সারা দেশের কিশোর-কিশোরীদের সাইবার বুলিং থেকে রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবছেন বলে এক সাক্ষাতকারে বেনারকে জানিয়েছেন সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার জয়ী কিশোর সাদাত রহমান (১৭)।

‘সাইবার টিনস’ নামের একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নড়াইলে কিশোর-কিশোরীদের ‘সাইবার বুলিং’ থেকে রক্ষায় ভূমিকা রাখার জন্য গত শুক্রবার নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে পুরস্কার গ্রহণের পর ঢাকায় ফিরে সাদাত বেনারকে জানান, এই পুরস্কার তাঁর দায়িত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

বর্তমানে অন্য জেলাগুলো থেকেও তাঁর সংগঠন ‘নড়াইল ভলান্টিয়ার্স’ এর কাছে প্রচুর অভিযোগ আসছে বলে জানান তিনি।

“এতদিন নড়াইল জেলার পুলিশ যতটুকু পেরেছে সাহায্য করেছে। কিন্তু সাইবার টিনসের কার্যক্রম এখন ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে দিতে হবে,” বেনারকে বলেন নড়াইল আবদুল হাই সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সাদাত।

আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার কারণে এখন তাঁদের নিজের এলাকার বাইরে সহায়তা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে জানিয়ে সাদাত বলেন, “এখন একটাই প্রশ্ন, নড়াইলের বাইরের জেলাগুলোর ভুক্তভোগীদের কীভাবে সাহায্য করব?”

“পিরোজপুরের রোকাইয়া রূপার আত্মহত্যার ঘটনা দেখে কার্যক্রম শুরু করেছিলাম, কিন্তু সেই জেলায় আমরা এখনও কিছু করতে পারিনি,” বলেন সাদাত।

উল্লেখ্য, গত বছরের ৩০ আগস্ট আত্মহত্যাকারী পিরোজপুর ভাণ্ডারিয়ার সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রোকাইয়া রূপাকে তামিম খান নামে এক বখাটে যুবক প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল।

রূপা রাজি না হওয়ায় তাঁর একটি ছবি সম্পাদনার মাধ্যমে বিকৃত করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় তামিম। নিজের আপত্তিকর সেই ছবি দেখে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় মেয়েটি।

ওই ঘটনার সংবাদ শুনে তাঁর ‘খুব রাগ হয়’ জানিয়ে সাদাত বলেন, তখন থেকেই তিনি চিন্তা করতে থাকেন এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার যেখানে কিশোর-কিশোরীরা যে কোনো জায়গা থেকে নিজেদের কথাগুলো গোপনেই জানাতে পারবে এবং সহায়তা পাবে।

“এভাবেই সাইবার টিনসের যাত্রা শুরু করি। ওয়েবসাইট বানাই, এ্যাপস বানাই – যাতে কিশোর-কিশোরীরা তাদের সমস্যার কথা জানাতে পারে,” বলেন তিনি।

প্রসঙ্গত নেদারল্যান্ড ভিত্তিক কিডসরাইটস ফাউন্ডেশন প্রতি বছর শিশু শান্তি পুরস্কার দিয়ে থাকে। এর আগে এই পুরস্কার জয়ীদের মধ্যে রয়েছেন পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই ও সুইডিশ পরিবেশবাদী কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ।

ঢাকায় বাবা মো. সাখাওয়াত হোসেনের সাথে আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরষ্কার জয়ী কিশোর সাদাত রহমান। ১৭ নভেম্বর ২০২০।
ঢাকায় বাবা মো. সাখাওয়াত হোসেনের সাথে আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরষ্কার জয়ী কিশোর সাদাত রহমান। ১৭ নভেম্বর ২০২০।
[শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]

যেভাবে কাজ করে সাইবার টিন

সাদাতের উদ্যোগেই ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে গড়ে ওঠা সংগঠন নড়াইল ভলান্টিয়ার্সের একটি প্রকল্প হিসেবে গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সাইবার টিনসের যাত্রা শুরু হয়। এক্ষেত্রে নড়াইলের জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সার্বিক সহায়তা পেয়েছেন তাঁরা।

কিশোর-কিশোরীদের উদ্দেশ্যে সাইবার টিনসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, “যেভাবে তুমি সাইবার বুলিংএর শিকার হয়েছে তার উপযুক্ত প্রমাণ (স্কিনশট, ওয়েব লিংক)-সহ বিস্তারিত তথ্য আমাদের ওয়েবসাইটে বা অ্যাপে সাবমিট করলেই অভিযোগ করা হয়ে যাবে। এরপর আমরা তোমার সাথে যোগাযোগ করব।”

সাধারণত সাইবার বুলিংয়ে শিকার কিশোর-কিশোরী বিষয়গুলো বাবা-মাকে জানালে উল্টো বকা খেতে হয়, ফলে বিষয়গুলো তারা গোপন রাখে জানিয়ে সাদাত বলেন, “অধিকাংশ টিনেজার পুলিশকেও ভয় পায়। তাছাড়া সাইবার বুলিং সম্পর্কে সব পুলিশ কর্মকর্তারও পরিষ্কার ধারণা নেই।”

“পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যাদের কিশোর-কিশোরী সন্তান নেই, তারা ওই বয়সীদের সমস্যাটা অনুভবই করতে পারেন না,” জানিয়ে সাদাত বলেন, “সমবয়সী হওয়ার কারণে আমরা তাঁদের সমস্যা অনুভব করতে পারি।”

“যে কারণে চেনাজানা না থাকা সত্ত্বেও ওরা আমাদের কষ্টের কথাগুলো জানাচ্ছে,” বলেন তিনি।

ওয়েবসাইট, অ্যাপস বা ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে পাওয়া অভিযোগগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় জানিয়ে সাদাত বলেন, এর মধ্যে প্রযুক্তিগত সমস্যাগুলো সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে এবং আইনগত সমস্যাগুলো পুলিশ সুপারের কাছে পাঠানো হয়।

এর বাইরে বুলিংয়ের শিকার হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া অনেকের অনুপ্রেরণার প্রয়োজন হয়। “এমন ঘটনায় অনুপ্রাণিত করার জন্য টিনেজারদের প্রিয় সেলিব্রেটিদের নিয়ে একটি প্যানেল গড়ে তোলার চেষ্টা করছে সাইবার টিনস,” বলেন সাদাত।

সাইবার টিনসের সহায়তায় নড়াইলে সাইবার বুলিংয়ের সাথে জড়িত আট অপরাধীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় বলে সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জানান পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ।

সাইবার জগতে নারীদের নিরাপদে রাখতে সোমবার ওই সেবাটি উদ্বোধনকালে সাদাতের প্রশংসা করে আইজিপি বলেন, “যখনই কেউ সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার হয়েছে, সাদাত পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।"

সাদাত দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে বলে মন্তব্য করেন ড. বেনজীর।

এ পর্যন্ত সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখে সাইবার টিনস নড়াইলে আড়াই শতাধিক কিশোর-কিশোরীকে প্রযুক্তি ও আইনগত সহায়তা দিয়েছে বলে জানান সাদাত।

এছাড়া গত কয়েক দিনে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তাঁরা শতাধিক সাইবার বুলিংয়ের অভিযোগ পেয়েছেন বলে বেনারকে জানান নড়াইল ভলান্টিয়ার্সের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাইবার টিনসের মুখপাত্র মেহেদী হাসান।

তিনি জানান, এই সময়ে কয়েক হাজার মানুষ তাদের অ্যাপটি ডাউনলোড করেছে।

যেভাবে বেড়ে উঠেছেন সাদাত

বাড়ি মাগুরা হলেও পোস্টমাস্টার বাবার চাকরির সুবাদে নড়াইলের আগে সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী ও ফরিদপুরে থেকেছেন সাদাত।

“ছোটবেলায় দেখতাম, অনেক খেলনা দিলেও সে শুধু ওই মোবাইল নিয়েই নাড়াচাড়া করত,” জানিয়ে বাবা মো. সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, পঞ্চম শ্রেণিতে থাকতেই ‘অ্যান্ড্রয়েড সেট’ ব্যবহার করছে সাদাত, আর ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে কম্পিউটার।

কম্পিউটার হাতে পাওয়ার পরপরই ডিজিটাল মেলার প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ায় সন্তানকে সার্বিক সহায়তা করে গেছেন সাখাওয়াত।

২০১৮ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গবেষণা উইং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইয়ং বাংলার দেওয়া জয়বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড পায় সাদাতের সংগঠন। এটা ছিল তাঁর জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’।

সাদাত জানান, এরই পেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সান্নিধ্য লাভ তাঁকে উজ্জীবিত ও সামাজিকভাবে শক্তিশালী করেছে।

অনলাইনে শান্তি ও সুরক্ষা বজায়ে প্রযুক্তিগত সমাধানের ধারণা বিষয়ে জাতিসংঘ আয়োজিত একটি প্রতিযোগিতায় গত ২১ সেপ্টেম্বর তিনটি প্রতিষ্ঠানকে সেরা ঘোষণা করা হয়, সেখানেও স্থান পান সাদাতরা। যার প্রেক্ষিতে ২০২১ সালে সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পাবে নড়াইল ভলান্টিয়ার্স।

এছাড়া বেসরকারি সংস্থা এ্যাকশন এইডের ইয়ুথ ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ-২০১৯ সম্মাননা এবং সচেতনতামূলক স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি তৈরি করেও বেশ কিছু পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন তাঁরা।

সাদাতের দাবি, বাংলাদেশে তাঁর চেয়েও মেধাবী কিশোর-কিশোরী আছে। কিন্তু অভিভাবকেরা শুধু পড়াশোনার জন্য চাপ দেওয়ায় এবং স্কুল-কলেজগুলোয় এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিজে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট না থাকায় তাদের মেধা বিকশিত হচ্ছে না।

সাদাতের মতে, শুধু মেয়েরা নয়, অনেক ছেলেরাও নানা ধরনের সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে।

এদিকে বর্তমানে সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে যে কেউ দেশের যে কোনো জায়গা থেকে “সরাসরিই পুলিশের সাথে যোগাযোগ করতে পারে,” বলে বেনারকে জানান পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. সোহেল রানা।

তবে আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলন্ড্রেনের শিশু সুরক্ষা বিষয়ক পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুনের মতে, “সরকারের এ বিষয়ক যেসব ‘হটলাইন’ লাইন আছে, তার সাথে সাদাতদের ওয়েবসাইট বা এ্যাপটিকে একীভূত করা যেতে পারে।”

“সাদাতের উদ্যোগটি বাস্তবায়নে এখন সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে, যাতে তাঁর নড়াইলের মডেলটি সারাদেশে বাস্তবায়ন করা যায়,” বলেন আবদুল্লাহ আল মামুন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।