বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণি’, তবে কিছুটা দুর্বল
2019.05.03
ঢাকা

ভারতের উড়িষ্যায় আঘাত হেনে কিছুটা দুর্বল হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ঘূর্ণিঝড় ফণির অগ্রভাগ। এর মূল অংশটি শনিবার সকালের পর খুলনা ও সাতক্ষীরাসহ উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ঘূর্ণিঝড়টির অতি প্রবল হবার কোনো আশঙ্কা নেই।
বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত সোয়া দশটার দিকে সর্বশেষ ব্রিফিংয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শামছুদ্দিন আহমেদ জানান, বর্তমানে বাংলাদেশের সীমানা থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করা ফণির মূল অংশটি ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা পর এদেশের ভূমিতে প্রবেশ করবে।
তিনি জানান, শনিবার দুপুর ১২টার মধ্যে যশোর ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে এটি প্রবেশ করতে পারে। ঘূর্ণিঝড়টি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২১ কিলোমিটার করে অগ্রসর হচ্ছে।
শামছুদ্দিন আহমেদ জানান, “অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় নয়, শুধু ঘূর্ণিঝড় হিসেবেই ফণি বাংলাদেশে প্রবেশ করবে।”
এসময় বাতাসের গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় ১০০-১২০ কিলোমিটার। এ গতি সাত নম্বর বিপদ সঙ্কেত নির্দেশ করে। কাজেই মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে দেখানো সাত নম্বর বিপদ সংকেত অব্যাহত থাকবে।
ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে বলে এর আগে সন্ধ্যায় সচিবালয়ের সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন শামছুদ্দিন আহমেদ।
এ সময় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
১০০ কিলোমিটার গতিবেগ হলেও অতীতে এমন ঝোড়ো হাওয়াতেও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানান শামছুদ্দিন আহমেদ।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ফণির কারণে সারা দেশে ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টির প্রবণতা শনিবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। ফণির প্রভাবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ফণির ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের ১২ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রবর্তী অংশের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় শুক্রবার সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। রাজধানীতেও কয়েক দফা বৃষ্টি হয়। প্রায় সারা দেশের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। এদিন বাংলাদেশে বজ্রপাতে ছয়জনের মৃত্যুও হয়েছে। শক্তিশালী জোয়ারে উপকূলীয় বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বেশ কিছু গ্রাম।
১২ লাখ মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে
ফণির ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উপকূলীয় ১৯টি জেলার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার ১২ লাখ ৪০ হাজার ৭৯৫ জন মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে বলে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব শাহ কামাল।
তিনি বেনারকে বলেন, “রাতের মধ্যে আরও ৩-৬ লাখ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হতে পারে। তবে ঘূর্ণিঝড়ের গতি কিছুটা কমে আসায় অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে যেতে চাইছেন না।”
উপকূলের মানুষদের আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া সহ বিভিন্ন কার্যক্রমে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ, আনসার-ভিডিপি, স্বেচ্ছাসেবকসহ রাজনৈতিক কর্মীরা অংশ নিচ্ছেন বলে জানান ত্রাণ সচিব।
এখন পর্যন্ত ফণির ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় আমরা সক্ষম জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, “ঘূর্ণিঝড়ে যাতে কোনো প্রাণনাশের ঘটনা না ঘটে, সে ব্যাপারে আমরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছি। এখন পর্যন্ত কোনো প্রাণহানির খবর পাইনি।”
সাংবাদিকদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব জানান, এসব জেলার ১৪৭টি উপজেলার ১৩ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা উপকূলীয় এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের বসবাস করা এসব এলাকায় চার হাজার ৭১টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে, যার বেশির ভাগই প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
বজ্রপাতে মৃত্যু
ঘূর্ণিঝড় ফণির প্রভাবে শুক্রবার সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এ সময় বজ্রপাতে কিশোরগঞ্জ জেলায় ছয়জন নিহত হন।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, নিহতরা হলেন- মিঠামইন উপজেলার কেওয়ারজোড় ইউনিয়নের কুড়ারকান্দি গ্রামের এবাদ মিয়ার ছেলে সুমন মিয়া (৭), বৈরাটি ইউনিয়নের বিরামচর গ্রামের মো. মহিউদ্দিন (২২), পাকুন্দিয়া উপজেলার সুখিয়া ইউনিয়নের কোষাকান্দা গ্রামের আসাদ মিয়া (৪৫) ও ইটনা উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের কাঠুইর গ্রামের রুবেল দাস (২৬), চর আলগি গ্রামের মুজিবুর রহমান (৩৫) ও নুরুন্নাহার (৩২)।
পুলিশ জানায়, এদের কেউ কেউ বৃষ্টিপাতের মধ্যে হাওরে গরু আনতে গিয়ে, কেউ ধান কাটার সময় বজ্রপাতের শিকার হন।
বাঁধ ভেঙে ২৯ গ্রাম প্লাবিত
ঘূর্ণিঝড় ফণির প্রভাবে শক্তিশালী জোয়ারে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালী ও বাগেরহাটের অন্তত ২৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পটুয়াখালীতে বেশ কিছু স্থানে বাঁধ ভেঙে ও পানি উপচে তিনটি উপজেলার অন্তত ২৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘর এবং ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।
পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, বাঁধের কয়েকটি স্থান আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত থাকায় নদীর পানি বাড়ার সাথে সাথে ওসব পয়েন্ট দিয়ে গ্রামগুলোতে পানি ঢুকেছে।”
এছাড়া বেড়িবাঁধ উপচে বাগেরহাটের সুন্দরবন সংলগ্ন শরণখোলা উপজেলার চারটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
বাগেরহাটের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান খান বেনারকে বলেন, “ঘূর্ণিঝড় ফণির প্রভাবে নদীগুলোতে পানির চাপ বাড়ায় শরণখোলায় বাঁধের নিচু অংশ দিয়ে পানি ঢুকে কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তবে আমরা সতর্ক আছি।”
রোহিঙ্গা শিবিরে বাড়তি সর্তকতা
ঘূর্ণিঝড় ফণির কারণে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বাড়তি সতর্কতা নিয়েছে সরকার। পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের ঝুঁকিতে থাকা রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার বেনারকে বলেন, “ইতিমধ্যে যেসব রোহিঙ্গা পাহাড়ি ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর আশপাশের এলাকার আশ্রয় কেন্দ্রও প্রস্তুত রাখা রয়েছে।”
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও জানমাল রক্ষার ক্ষেত্রে সেখানে ১০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান রমিদা বেগম বলেন, “পাহাড়ে মাঝখানে গড়ে ওঠা এ শিবিরের ৫০ হাজার বাসিন্দাই ঝুঁকিতে রয়েছে। বুঝতে পারছি না কাকে রেখে, কাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হবে। তবুও গত দুই দিন ধরে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঝুঁকিতে থাকা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থানে নেমে আসার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।”
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ফণি আঘাত হানার আগেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের সব সংস্থা ও বেসরকারি সংগঠনগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করা প্রধানমন্ত্রী দেশের পরিস্থিতির সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখছেন। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন।”
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।