গাজীপুরে পুলিশ হেফাজতে নারীর মৃত্যু: তদন্তের নির্দেশ দিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
2020.02.21
ঢাকা

গাজীপুরে গ্রেপ্তারের পর এক নারীর মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ হেফাজতে আসামিদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ওই ঘটনা তদন্তে পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন।
“স্বজনদের অভিযোগ এবং গণমাধ্যমের খবর দেখে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন,” শুক্রবার বেনারকে জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়রে তথ্য কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, ২০১৯ সালে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মোট ১৮ জন মারা যান, যা ২০১৮ সালে ছিল ১৭ ও ২০১৭ সালে ১৫৷
“শুধু জানুয়ারি মাসেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহের হাতে বিচারবহির্ভূত অন্তত ২৩ জনের মৃত্যুর সংবাদ আমরা পেয়েছি,” বেনারকে বলেন আসক’র নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা।
যদিও তিনি এগুলোর মধ্যে হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা তাৎক্ষণিক আলাদাভাবে দিতে পারেননি। তবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী চলতি বছর ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখ পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে অন্তত তিনটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
“পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চুড়ান্ত রূপ, এটা জঘন্য অপরাধ। আমরা প্রতিটি ঘটনার তদন্ত এবং সুবিচার নিশ্চিত করার জোর দাবি জানাচ্ছি,” বলেন শিপা হাফিজা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণমাধ্যম ও জনসংযোগের দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশের সহকারি মহাপরিদর্শক সোহেল রানা বেনারকে বলেন, “হেফাজতে নির্যাতন বা হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।”
“কোনো অভিযোগ সত্য হলে বিভাগীয় শাস্তি ও ফৌজদারি বিচারের ব্যবস্থা রয়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “গাজীপুরের অভিযোগটিও তদন্ত করে অভিযোগের প্রমাণ পেলে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
চলতি বছরে তিনটি মৃত্যু
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভাওয়াল গাজীপুর গ্রামের আবদুল হাইয়ের স্ত্রী ইয়াসমীন বেগমকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ওই রাতে তিনি মারা যান।
পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। আর পুলিশ বলেছে, হার্ট অ্যাটাকে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
এ ঘটনায় গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আজাদ মিয়াকে প্রধান করে হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি হয়েছে।
তবে তার আগে পুলিশ ইয়াসমীনের বিরুদ্ধে একটি মাদক এবং আরেকটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করে।
গত ১৯ জানুয়ারি ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার হাজতে মারা যান বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) ফ্লোর ইনচার্জ আবু বক্কর সিদ্দিক বাবু। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে পুলিশ বলেছিল, তিনি হাজতের গ্রিলের সঙ্গে চাদর পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
তবে পুলিশের এই ভাষ্য মানতে রাজি নন নিহত বাবুর স্বজনেরা। ঘটনাটি তদন্তে পুলিশের পক্ষ থেকে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ ছাড়া ২ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী থানা হাজতে মারা যাওয়া ব্যাটারি রিকশাচালক মোজাফ্ফরের মৃত্যুর ঘটনায়ও একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার মহিবুল ইসলাম। তাঁর মৃত্যুর পর পুলিশ বলেছিল, মোজাফ্ফর অ্যাজমা রোগে মারা গেছেন।
“সাম্প্রতিক কালে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠছে এবং গ্রেপ্তার অবস্থায় একের পর এক ব্যক্তি মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। নিহতদের পরিবার থানা হেফাজতে নির্যাতন এবং নির্যাতনের ফলে মৃত্যুর অভিযোগ তুলছে,” বেনারকে বলেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।
তাঁর মতে, “অভিযুক্তদের জবাবদিহি করতে হয় না বলেই এমন মৃত্যুর ঘটনা থামছে না।”
হেফাজতে হত্যা-নির্যাতনের বিচার নেই
হেফাজতে নির্যাতন এবং নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার ঘটনা অসংখ্য হলেও এসব ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করার নজির খুব কম।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতে থাকাকালীন নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার অভিযোগে দায়েরকৃত ১৬টি মামলার মধ্যে শুধু একটিতে (সিলেটের কোতয়ালি মডেল থানা, ৩০ আগস্ট, ২০১৪) অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ।
এছাড়া ঢাকার একটি মামলার (মিরপুর থানা) বিচার চলছে। ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট পুলিশ হেফাজতে জনি নামে এক যুবক মারা গেলে তাঁর ভাই ইমতিয়াজ হোসেন আদালতে এই মামলা করেন।
বাকি ১৪টি মামলার খুব একটা অগ্রগতি নেই বলে পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে।
হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনায় মামলা কম হওয়া প্রসঙ্গে শীপা হাফিজা বলেন, “সুবিচার পাবে—ভুক্তভোগিদের মধ্যে এমন আস্থা থাকলে সবাই মামলা করত। তা ছাড়া মামলা করে অনেকেই আরও ঝুঁকিতে পড়েন।”
তাঁর মতে, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় যারা বিচার চাচ্ছেন, সরকারের উচিত তাঁদের আইনি সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দেওয়া।”