ঢাকায় ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তার, ঈদে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা
2019.08.01
ঢাকা

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু রোগের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। আসন্ন ঈদুল আজহার পর রোগটি সারা দেশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত সারাদেশে ১৪ জন মারা গেছেন। তবে বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা কমপক্ষে ৬৫।
বৃহস্পতিবারও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ডেঙ্গুতে শারমিন (২২) নামের এক তরুণীর মৃত্যু হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক কামদাপ্রসাদ সাহা।
বৃহস্পতিবার সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়, গতকাল সকাল আটটা থেকে ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৭১২ জন। ৫ হাজার ৮৩৮ জন ডেঙ্গু রোগী সারাদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
এর আগে ২০১৮ সালে দেশে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ১১ হাজার। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দুর্যোগ ঘোষণার দাবি তুলেছে।
ঈদে আরো বিস্তারের আশঙ্কা
বৃহস্পতিবার মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজে একটি সেমিনারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, “কোরবানি ঈদের কারণে মানুষ ঢাকার বাইরে যাবেন। তখন সারা দেশে ডেঙ্গু রোগের বিস্তার ঘটতে পারে।”
“তবে ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকার সকল কিছু করবে,” বলেন তিনি।
বেনারের কাছে ডেঙ্গু জ্বর বিস্তার প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে প্রিভেনটিভ মেডিসিন গবেষক ড. লেলিন চৌধুরী বলেন, “একজন ডেঙ্গু রোগীকে কোনো এডিস মশা কামড় দিলে সেই এডিস মশাটি ডেঙ্গুর জীবাণুতে আক্রান্ত হয়। সে তখন ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করে।”
“এই মশা আরেকজন সুস্থ মানুষকে কামড় দিলে সেই ব্যক্তির ডেঙ্গু হতে পারে,” বলেন তিনি।
ড. লেলিন বলেন, “এখন আমরা ডেঙ্গু নিয়ে দুর্যোগে আছি। কোরবানি ঈদের পর এটি মহাদুর্যোগে পরিণত হবে, যদি আমরা সবাই মিলে একত্রে এডিস মশা ধ্বংস করার ব্যবস্থা না করতে পারি।”
নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে বর্তমানে বিভিন্ন জেলার হাসপাতালগুলোতে তিন হাজার ৪৬৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি, ৭০৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন ঢাকা মেডিকেলে।
ড. লেলিন চৌধুরী বলেন, “সরকারি হিসাবে ১৪ জনের মৃত্যুর খবর বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে ডেঙ্গুর কারণে মৃত্যুর সংখ্যা কমপক্ষে ৬৫ জন। কিন্তু প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা কমপক্ষে দ্বিগুণ। কারণ অধিকাংশ দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের মানুষ ডেঙ্গুর কারণে মৃত্যুর বিষয়টি সরকারকে অবহিত করেন না।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ধরা যাক একটি ছোট শিশুর জ্বর হলো। আর দুদিন পরে জ্বর চলে গেল। বাবা-মা মনে করে সে সুস্থ হয়ে গেছে। পাঁচ-ছয় দিন পরে যখন বাচ্চাটির প্লেটলেট কমা শুরু হয় তখন হঠাৎ শরীর ঠাণ্ডা হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে শিশুটি। সে ক্ষেত্রে ওই মৃত্যুকে ডেঙ্গুর কারণে মৃত্যু হিসাবে গণ্য করা হয় না।
ড. লেলিন বলেন, ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু রোগ ধরা পড়ে। এরপর থেকে ডেঙ্গু মূলত ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যদিও ঢাকার বাইরে অল্পসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী দেখা গেছে।
তিনি বলেন, এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বৃষ্টি হওয়ার কারণে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। এরপর ঢাকায় অন্যান্য সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। কিন্তু বিষয়টি জানার পরও দুই সিটি করপোরেশন মশার লার্ভা ধ্বংসের কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় ঢাকায় ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে।”
তিনি বলেন, “কয়েক দিন পর ঢাকা থেকে মানুষেরা কোরবানি ঈদ পালন করতে বিভিন্ন ছোট শহর ও গ্রামে চলে যাবেন। তখন সারা দেশে ডেঙ্গু রোগের বিস্তার ঘটবে।”
তাপমাত্রা বৃদ্ধি ডেঙ্গুর অন্যতম কারণ
পরিবেশবিদ ও গবেষক ড. আইনুন নিশাত বেনারকে বলেন, বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতৈক্য রয়েছে যে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পোকামাকড় যেমন মশা, মাছি, মাকড়সার বিস্তার ঘটবে।”
“বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশেও ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এডিসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মশার বিস্তার ঘটছে,” বলেন তিনি।
ড. আইনুন বলেন, কারণ, মশা-মাছির বংশ বিস্তারের একটি উপযোগী তাপমাত্রা রয়েছে। শীত বেশি পড়লে মশা-মাছিসহ অন্যান্য পোকামাকড় মরে যায়। যেহেতু এখন শীত তেমন পড়ে না সেহেতু মশা-মাছি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি বলেন, “যখন মশা-মাছি বৃদ্ধি পাবে তখন এদের মাধ্যমে বিস্তার ঘটা রোগের প্রকোপ বাড়বে। আমরা তাই দেখছি আর এর ফলে ভেক্টরবাহী রোগ যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ইয়োলো ফিভার বৃদ্ধি পাবে।”
ড. নিশাত বলেন, “ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার বংশ বিস্তারে প্রয়োজন উচ্চ তাপমাত্রা যা এখন বাংলাদেশে রয়েছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক সেব্রিনা ফ্লোরা বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ডেঙ্গু সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়বে। এরপর ধীরে ধীরে কমে আসবে।”
তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়র সাঈদ খোকন বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সবাই সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে কাজ করছে।”
তিনি বলেন, “পাশাপাশি নাগরিকদের মধ্যেও সচেতনতা আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আগামী সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এটা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করছি।”
ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে সরকার কী করছে তা জানতে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদকে তলব করে উচ্চ আদালত। বৃহস্পতিবার বেলা ২টায় বিচারপতি তারিক-উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর বেঞ্চে উপস্থিত হন তিনি।
সরকার ও সিটি করপোরেশনের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে আদালতকে অবহিত করেন সচিব হেলালুদ্দিন।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে নামার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার টেলিকনফারেন্সে ঢাকার বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যে এ আহবান জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন।