সরকারি তথ্য: পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গুতে ৩৮ জনের মৃত্যু

পরিতোষ পাল
2017.11.21
কলকাতা
171121-BD-dengue-620.jpg ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে রোগীরা। নভেম্বর ০৪, ২০১৭।
বেনার নিউজ

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মশাবাহিত ডেঙ্গু ও অজানা জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এই বছরে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩৮ জনের। আরও ২২ জনের মৃত্যুর কারণ রক্ত পরীক্ষার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে গত ১৬ নভেম্বরে কলকাতা হাইকোর্টে দেওয়া তথ্যে বলা হয়, গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে আরও ১৫ জনের।

রাজ্যের সর্বশেষ ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্ব রঞ্জন শতপতি বেনারকে বলেন, “আদালতে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে সেটিই সর্বশেষ তথ্য।” বিচারাধীন বিষয় বলে এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি।

স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ৪০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও ১৫টি মৃত্যুর নিশ্চিত কারণ ছিল ডেঙ্গু।২২টির ক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়ার আগে ডেঙ্গুতে তাদের মৃত্যু হয়েছে কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তিনজনের ক্ষেত্রে অবশ্য মৃত্যু হয়েছে অন্য কারণে।

কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের জাতীয় পতঙ্গ বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের তথ্যে বলা হয়েছে, গত বছর রাজ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২২ হাজার ৮৬৫ জন। আর মৃত্যু হয়েছিল ৪৫ জনের।

প্রতিদিনই গণমাধ্যমে ডেঙ্গু ও অজানা জ্বরে একাধিক মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হচ্ছে। গত ৭২ ঘণ্টায় কলকাতাসহ রাজ্যে ১৩ জনের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।

রাজ্যে এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বাড়ার কারণ সম্পর্কে কলকাতার ট্রপিক্যাল স্কুল অব মেডিসিনের সাবেক অধিকর্তা ডা. অমিয় কুমার হাটি বেনারকে বলেন, “ডেঙ্গুর পরিচিত দুই ভাইরাস ডেঙ্গু-১ ও ডেঙ্গু-৩-এর পরিবর্তে এ বছর ডেঙ্গু-২ ডেঙ্গু-৪-এ আক্রান্ত হয়েছেন মানুষ বেশি। এই দুটি ভাইরাসে আক্রান্তদের ডেঙ্গুর সঠিক উপসর্গ অনেক ক্ষেত্রেই ধরা পড়ছে না। ফলে দেরিতে হাসপাতালে যাওয়ায় চিকিৎসা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং মৃত্যু হচ্ছে।”

চিকিৎসক ডা. অমিতাভ সাহা বেনারকে বলেন, “ডেঙ্গুর যে রূপ এ বছর আমরা দেখছি, তা অনেকটাই অজানা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংক্রমণের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না। ফলে আতঙ্ক বাড়ছে মানুষের মধ্যে।”

খোঁজ নিয়ে জানায়, রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালেই ডেঙ্গু ও জ্বরে আক্রান্ত প্রচুর রোগী ভর্তি রয়েছেন। সরকারি তথ্য মতে, রাজ্যে এখন পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে এক লাখ ৩০ হাজার জনের ডেঙ্গুর জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২১ হাজার জনের রক্তে ডেঙ্গুর জীবাণু পাওয়া গেছে।

বেসরকারি হাসপাতালের হিসেব ধরলে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি হবে বলেই জানিয়েছেন রাজ্যের জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সমাজ কর্মী আশীষ বর্মন।

তবে সরকারি তথ্যের সঙ্গে একমত নয় রাজ্যের বিরোধী দলগুলো। ইতিমধ্যেই তথ্য গোপনের অভিযোগ এনে রাস্তায় বিক্ষোভও করেছেন তারা।

প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি অধীর চৌধুরী বেনারকে বলেন, “ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রশাসনের ব্যর্থতাকে চাপা দিতেই মৃত্যুর তথ্য গোপন করা হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “রাজ্যে ডেঙ্গু মহামারির আকার ধারণ করেছে। আমাদের কাছে খবর একশ’রও অনেক বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে মারা গেছে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে উদাসীন।”

কলকাতা শহরে ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রশাসনের ব্যর্থতার প্রতিবাদে বামপন্থীদের বিক্ষোভ। নভেম্বর ১১, ২০১৭। ছবি : বেনার নিউজ
কলকাতা শহরে ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রশাসনের ব্যর্থতার প্রতিবাদে বামপন্থীদের বিক্ষোভ। নভেম্বর ১১, ২০১৭। ছবি : বেনার নিউজ

 

রাজ্যের বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বেনারকে বলেন, “তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ডেঙ্গুর কথা স্বীকার করছে না। এটা অমানবিক এবং অপরাধ। কত মানুষ মারা গেছে তার সঠিক তথ্যও জানাচ্ছে না সরকার।”

রাজ্যের গভর্নর কেশরিনাথ ত্রিপাঠি গত ২ নভেম্বর মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

মুখ্যমন্ত্রী ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বিগ্ন নন

ডেঙ্গু মহামারির আকার ধারণ করেছে বলে বিরোধীরা দাবি জানালেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেছেন, “ডেঙ্গু নিয়ে তিনি উদ্বেগের কোনো কারণ দেখছেন না। এটা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা চলছে।”

স্বাস্থ্য দপ্তরের এক আধিকারিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “ডেঙ্গু মোকাবিলায় নিয়মিত বৈঠক করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী সব পুরসভা ও পঞ্চায়েতকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় তৎপরতার সঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।”

সরকারের চাপে চিকিৎসকেরা ডেঙ্গুতে মৃত্যুর কথা লিখছেন না বলে অভিযোগ করছেন বহু মৃতের পরিবার। দিন পনেরো আগে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে জলি সরকার নামে এক রোগিণীর ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ লেখা হয়েছে রক্তস্বল্পতা ও সেপ্টিসেমিয়া।

রোগিণীর স্বামী গৌতম সরকার বেনারকে বলেন, যে হাসপাতালে প্রথমে ভর্তি করা হয়েছিল সেই হাসপাতালের রক্ত পরীক্ষায় এনএস ১ ও আইজিএম পজিটিভ বলে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল।

আদালতেও আইনজীবী রবিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা হলেও মৃত্যুর কারণ হিসেবে তা লেখা হচ্ছে না।”

ডেঙ্গুর তথ্য জানতে মামলা

চলতি বছর পশ্চিমবঙ্গে এ পর্যন্ত কতজনের ডেঙ্গুতে এবং অজানা জ্বরে মৃত্যু হয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নিয়মিত প্রকাশ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষে দেওয়া তথ্যে বিভ্রান্তিই তৈরি হয়েছে।

কতজনের মৃত্যু হয়েছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা কত তা জানার জন্য কলকাতা হাইকোর্টে ৬টি জনস্বার্থ মামলা হয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও বিজেপির পক্ষ থেকেও মামলা করা হয়েছে।

এই মামলার কয়েক দফা শুনানিতেও রাজ্য সরকার বিভিন্ন তথ্য আদালতে জানিয়েছে। প্রথমে বলা হয়, ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। পরে ৩৮ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়। সরকারের দেওয়া এসব তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আদালতের বিচারপতিরাও।

সচেতনতা গড়ে তোলাই জরুরি

পশ্চিমবঙ্গ ডক্টরস ফোরামের সভাপতি ডা. রেজাউল করিম বেনারকে বলেন, “ডেঙ্গু রোগের ইতিহাস ২০০ বছরেরও পুরনো। কিন্তু এ বছর সরকার কেন ডেঙ্গু রোগের দায় নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে তথ্যের বিভ্রান্তির খেলায় নেমেছে সেটাই আমরা বুঝতে পারছি না।”

“বরং একে সামাজিক সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করে সরকার সচেতনতা তৈরির কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লে মানুষ উপকৃত হতেন,” মনে করেন তিনি।

চিকিৎসক দীপ্তেন্দু সরকার বেনারকে বলেন, “ডেঙ্গুর জীবাণুবাহিত মশা যে সব জায়গায় জন্ম নেয় সেই জায়গা গুলিকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে পারলেই ডেঙ্গুর মোকাবিলা সম্ভব। আর এ ব্যাপারে নাগরিকদের সচেতন করার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।