এক মাসের ব্যবধানে দুই সফটওয়্যার প্রকৌশলী নিখোঁজ

জেসমিন পাপড়ি
2019.05.06
ঢাকা
190506_Ataur_620.jpg স্ত্রী ও সন্তানের সাথে নিখোঁজ সফটওয়্যার প্রকৌশলী আতাউর রহমান শাহীন।
[ছবি: পরিবারের সৌজন্যে]

ঢাকায় এক মাসের ব্যবধানে দু’জন সফটওয়্যার প্রকৌশলী নিখোঁজ হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এদের কারোরই সন্ধান বের করতে পারেনি।

গত ১ এপ্রিল মিরপুর থেকে কামরুল হাসান এবং ২ মে তেজগাঁও থেকে নিখোঁজ হন আতাউর রহমান শাহীন। দুজনই পেশায় সফটওয়্যার প্রকৌশলী।

কামরুলের নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে এখনো কোনো ‘ক্লু’ না পেলেও আতাউরের ঘটনাটি অপহরণ বলে ‘অনেকটাই নিশ্চিত’ পুলিশ। একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে কালো কাচযুক্ত একটি সাদা হাইএস গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আতাউরকে।

বাংলাদেশে এর আগের অপহরণের ঘটনাগুলোর সাথে আতাউরকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার অনেক মিল আছে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরাও।

এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “এর আগেও আইটি বিশেষজ্ঞদের গুমের শিকার হতে দেখেছি। পরবর্তীতে কেউ কেউ ফিরেও এসেছেন।”

“রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে তার নাগরিককে কারা অপহরণ, গুম করছে তা খুঁজে বের করা। কিন্তু দুটি মানুষকে উঠিয়ে নেওয়া হলো সে ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্যও দেওয়া হয়নি। এর ফলে মানুষের মনে এক ধরনের ভীতিকর অবস্থা তৈরি হচ্ছে,” বলেন তিনি।

মিরপুর ডিওএইচএসের ৬নং লেনের ১০ নম্বর সড়কের একটি আইটি ফার্মে কাজ করতেন কামরুল। ১ এপ্রিল রাতে মিরপুর ডিওএইচএস এর এক নম্বর গেট এলাকা থেকে নিখোঁজ হন তিনি।

অন্য দিকে আতাউর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ‘বেঙ্গল গ্লাস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তি শাখায় সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন। একই সঙ্গে সপ্তাহে দুদিন তিনি (শুক্রবার ও শনিবার) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও কাজ করতেন বলে জানিয়েছেন তাঁর স্বজনেরা। ২ মে রাতে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকা থেকে ‘উঠিয়ে নেয়া হয়’ তাঁকে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ (আসক) কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ছয়জন নিখোঁজ হয়েছেন, তাদের মধ্যে ফিরে এসেছেন একজন।

অন্যদিকে গত বছর নিখোঁজ হওয়া মোট ৩৪ জনের মধ্যে দুজন ফিরে আসেন, ১৫ জনকে পরে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বাকিরা এখনো নিখোঁজ।

ক্লু মেলেনি কামরুলের

কামরুল হাসান।
কামরুল হাসান।
[ছবি: পরিবারের সৌজন্যে]
কামরুল নিখোঁজের ঘটনায় তাঁর বাবা বিমানবাহিনীর সাবেক মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার মো. রুস্তম আলী ২ এপ্রিল পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।

সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, ১ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে মিরপুরের বারণটেকের বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশে বের হন কামরুল। রাত পৌনে ১১টায় তাঁর স্ত্রীর মোবাইল ফোনে বার্তায় জানান যে, তিনি বাসার দিকে রওনা হয়েছেন। কিন্তু এরপর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও কামরুলের সন্ধান মেলেনি।

কামরুলের স্ত্রী শারমিন আক্তার বেনারকে বলেন, “থানা-পুলিশ ছাড়াও ডিবি ও র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেউ কামরুলের সন্ধান দিতে পারেনি। কেউ মুক্তিপণের জন্যও যোগাযোগ করেনি।”

কামরুলের নিখোঁজের ঘটনাটি তদন্ত করছেন পল্লবী থানার উপপরিদর্শক মুমিনুর রহমান। তিনি বেনারকে বলেন, “ঘটনার পর সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে অফিস থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তিনি হেঁটে আসছেন। কিন্তু মিরপুর ডিওএইচএস এর এক নম্বর গেটে দিয়ে বের হওয়ার পর তাঁর কোনো হদিস নেই।”

“কামরুলের মুঠোফোনের কললিস্ট এবং তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদেন ধরে তারা খোঁজ নিয়েছেন। কিন্তু কোনো ক্লু পাননি,” জানান তিনি।

পারিবারিক সূত্র মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন কামরুল। কিছুদিন আগে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরিচ্যুত হলে মিরপুর ডিওএইচএসের ১০ নম্বর সড়কের ওই ভবনে অফিস ভাড়া নেন তিনি।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সারুটিয়া গ্রামের বাসিন্দা কামরুল ঢাকায় বাবা-মা, স্ত্রী ও আড়াই মাস বয়সী এক কন্যাকে নিয়ে পল্লবীর বারণ টেকে থাকতেন।

তুলে নিয়ে যাওয়া হয় আতাউরকে

আতাউরের স্ত্রী তানিয়া আক্তার বেনারকে বলেন, “অফিস, বাসা আর বাইরের খণ্ডকালীন কাজ, এই ছিল আতাউরের জগত। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মোবাইল ফোনে কল করলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানান। পরে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পান।

আতাউর নিখোঁজের ঘটনায় শুক্রবার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় তাঁর পরিবার একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। শনিবার পুলিশ সেটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করে।

তানিয়ার বোনের জামাই মঞ্জুর হোসেন বেনারকে জানান, গুলশান লিংক রোডের পাশে নভো টাওয়ারে আতাউরের অফিস। সেখান থেকে বেলা দেড়টার দিকে বের হয়ে তিনি ও তাঁর এক সহকর্মী একই এলাকার আকিজ হাউসে খণ্ডকালীন একটি কাজের বিষয়ে কথা বলতে যান। আকিজ হাউস থেকে তাঁরা দুজন রাত ৮টার দিকে বের হন।

দুজনই মোবাইল ফোনের অ্যাপ ভিত্তিক পরিবহন সেবার জন্য আলাদাভাবে অনুরোধ পাঠান। সহকর্মীর মোটরসাইকেল রাইডার আগে চলে আসলে তিনি চলে যান।

মঞ্জুর বেনারকে জানান, আকিজ হাউস থেকে সংগ্রহ করা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে সহকর্মী চলে যাওয়ার পর তিনজন লোক তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। এ সময় অল্প দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মাইক্রোবাস ধীর গতিতে এগিয়ে তার সামনে আসে। মাইক্রোবাসের ভেতর থেকে কেউ দরজা খুলে দেয় এবং পেছনের তিনজন আতাউরকে ধরে মাইক্রোবাসে তুলে দেন।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি আলী হোসেন বেনারকে জানান, “সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তারা সাত –আটজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে নিশ্চিত হয়েছেন। ওই দিন দুপুর বেলার একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজেও এদের উপস্থিতি দেখা গেছে। তারা অনেকটাই নিশ্চিত যে আতাউরকে অপহরণ করা হয়েছে।

এদিকে আলোর স্বল্পতা ও সিসি ক্যামেরা দূরে থাকায় অপহরণকারীদের চেহারা বোঝা যায়নি এবং গাড়ির নম্বর প্লেটের জায়গাটাও সাদা দেখায় বলে বেনারকে জানান মঞ্জুর।

পরিবার জানায়, আতাউর ভারতের বেঙ্গালুরুতে পড়াশোনা করে দেশে এসে চাকরি শুরু করেন। স্ত্রী-সন্তান ও শ্যালককে নিয়ে মিরপুর-২ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকে নিজের ফ্ল্যাটে থাকতেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।