রহস্যজনকভাবে নিখোঁজদের তালিকায় এবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক

প্রাপ্তি রহমান
2017.11.09
ঢাকা
রংপুরে তোলা মোবাশ্বার হাসান এর একটি ছবি। ৩১ মে ২০১৫। রংপুরে তোলা মোবাশ্বার হাসান এর একটি ছবি। ৩১ মে ২০১৫।
AFP

রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকের পর এবার রহস্যজনকভাবে নিখোঁজের তালিকায় যুক্ত হলো এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের নাম। নিখোঁজ শিক্ষকের নাম মুবাশ্বার হাসান।

এ দফাতেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিখোঁজকে খুঁজে বের করার চেষ্টার কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বুধবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, “সরকারকে বিব্রত করতে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে যায়।”

এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের মত হচ্ছে, রাষ্ট্র এভাবে দায় এড়াতে পারে না।

“মৌলিক মানবাধিকারের প্রথম শর্ত হলো শঙ্কামুক্ত জীবনযাপনের অধিকার। প্রতিটি মানুষ শঙ্কায় আছে। এভাবে রাষ্ট্র তার দায় এড়াতে পারে না,” বেনারকে জানান মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, প্রত্যেককে খুঁজে বের না করতে পারলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনাস্থা চরমে পৌঁছাবে। এর ফল হবে অত্যন্ত খারাপ।

মুবাশ্বার হাসান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, সেজ, টেইলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস, হাভার্ড ইউনিভার্সিটি এশিয়া সেন্টার ও উইল থেকে তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে। গবেষণার প্রিয় বিষয় ছিল মৌলবাদ ও রাজনীতি। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রামের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন মুবাশ্বার।

গত ৭ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টা থেকে ওই শিক্ষক নিখোঁজ। ওই দিনই রাত আড়াইটার দিকে তাঁর বাবা মোতাহের হোসেন খিলগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। বুধবার সকাল ৯টায় র‍্যাব–৩ কেও জানান তাঁরা।

খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মশিউর রহমান সাংবাদিকদের জানান, নিখোঁজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে খুঁজে পেতে চেষ্টা করছেন।

“আমরা সন্ধ্যা ৬ টা ৪১ মিনিট পর্যন্ত মুবাশ্বার হাসানের খবর পাচ্ছি। তাঁর শেষ লোকেশন ছিল আগারগাঁওয়ে,” মশিউর রহমান বলেন।

র‍্যাব–৩ এর অধিনায়ক লে কর্নেল এমরানুল হাসান সাংবাদিকদের বলেছেন, মুবাশ্বারকে খুঁজে পেতে তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর বাসা থেকে ল্যাপটপ নিয়ে এসেছেন। সেখানে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।

মুবাশ্বার হাসান ঠিক কী কারণে নিখোঁজ, তাঁরা কাউকে সন্দেহ করছেন কি না সে ব্যাপারে পরিবারের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে কেউ কথা বলেননি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাঁর বাবা মোতাহের হোসেন একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছেন।

মোতাহের হোসেন লিখেছেন, “সরকারের কাছে আমরা আকুল আবেদন করছি, ছেলেকে ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক সাহায্য করার জন্য। আমি সবার কাছে অনুরোধ করব, আপনারা আমার ছেলের সুস্থ স্বাভাবিক প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রার্থনা করুন।"

তবে মুবাশ্বার হোসেনের চাচা ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর রিসার্চ ফেলো মনযুর হোসেন লিখেছেন, “আমি জানি না, মুবাশ্বার (সিজার) কী কারণে এবং কার বিরাগভাজন হয়েছেন? গবেষণা বা লেখালেখিতে ভিন্ন মতামত থাকতেই পারে এবং তা কারও মনঃপূত হতেও পারে বা নাও পারে। কিন্তু একাডেমিক ডিসকোর্সে সবাই তা মেনে নেয় কারণ তা শুধুমাত্র জ্ঞানচর্চাকেই সমৃদ্ধ করে।”

এদিকে নিখোঁজ হওয়ার কয়েক দিন আগে মুবাশ্বার হাসানের বাসায় দুইজন অপরিচিত ব্যক্তি এসেছিলেন বলে ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের বার্তা প্রধান জায়েদুল আহসান।

“ও আমাকে বলেছিল ওর বাসায় ছাত্র পরিচয়ে দুজন এসেছিল। তারা কারা ও বুঝতে পারছে না। আমি ওকে বাসায় সিসি ক্যামেরা লাগাতে বলি। সিসি ক্যামেরাও লাগিয়েছিল বলে শুনেছি,” ফেসবুকে জায়েদুল আহসান বলেন।

লম্বা হচ্ছে নিখোঁজদের তালিকা

গত ২২ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছেন নয়জন। পরিবারগুলো পাগলের মতো খুঁজছে স্বজনদের।

বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ী সাদাত আহমেদ ২২আগস্ট নিখোঁজ হন বনানী ফ্লাইওভারের নিচ থেকে। এই ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় জিডি করেছেন তাঁর স্ত্রী। সাদা পোশাকে একদল লোক যখন গাড়ি থেকে বের করে তাঁকে অন্য একটি গাড়িতে তোলে তখন তাঁর সঙ্গে তাঁর ছেলেও ছিল। গতকাল পর্যন্ত তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

২৭ আগস্ট একই দিনে নিখোঁজ হন কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমান ও ব্যবসায়ী এবং বেলারুশের অনারারি কনসাল অনিরুদ্ধ রায়।

আমিনুর রহমানের পরিবার প্রেস কনফারেন্স করেছেন। অনিরুদ্ধ রায়ের স্ত্রী শাশ্বতী রায় বলেছেন, “সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি একবার পুলিশ, একবার র‍্যাব একবার মানবাধিকার সংগঠনের কাছে দৌড়াই। কেউ কিছু বলতে পারে না। এ কেমন কথা?”

২৬ আগস্ট নিখোঁজ কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইশরাক আহমেদের বাবা মো. জামাল উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেছেন, এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে তিনি ছেলের খোঁজে যাননি।

৭ অক্টোবর তাবলিগ জামাতে সাভার যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি আরাফাত রহমান। আরাফাতের বাবা মমিনুল হক বলেন, বাবা–মা, আড়াই মাসের শিশুকন্যা ফেলে এভাবে আরাফাত নিরুদ্দেশ হতে পারে না। তিনি অন্য একটি সন্দেহের কথাও বলেছেন।

“নিখোঁজ অবস্থায় ২৭ অক্টোবর তার মেসেঞ্জার অ্যাকাউন্ট থেকে বেশ কয়েকটি বার্তা আসে। আমার ধারণা কেউ তাকে আটকে রেখে এসব লেখাতে বাধ্য করছে,” মমিনুল হক বলেন।

১০ অক্টোবর থেকে নিখোঁজ পূর্ব পশ্চিম বিডি অনলাইনের সাংবাদিক উৎপল দাসের বোন বিনীতা রাণী দাস বেনারকে বলেছেন, ভাই বেঁচে আছে এটুকু জানতে পারলেও তাঁরা বেঁচে যান।

“আমরা পুলিশের কাছে গেছি। র‍্যাব সদর দপ্তরে গেছি। আর কোথায় গেলে ভাইয়ের সন্ধান পাব বলুন। আমার মা ভাইয়ের শোকে পাগল,” জানান বিনীতা।

২৭ অক্টোবর থেকে নিখোঁজ সদ্য গঠিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জনতা পার্টির সভাপতি মিঠুন চৌধুরী ও আশিস ঘোষ। তাঁদের রাজনৈতিক সহযোগী স্বপন বর্মণ সাংবাদিকদের বলেছেন, ফরাশগঞ্জ এলাকা থেকে তাঁদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন পর্যন্ত তাঁরা কিছু জানেন না। মিঠুন চৌধুরীর স্ত্রী সুমনা চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন করে স্বামীর সন্ধান চেয়েছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।