দুর্যোগের কবলে পড়ে বঙ্গোপসাগরে ৭৫ জেলে নিখোঁজ
2018.09.24
ঢাকা

গত দুই মাসে বঙ্গোপসাগরে দুটি লঘুচাপের কারণে সৃষ্ট ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ঘটনায় কমপক্ষে ৭৫ জন জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁরা আদৌ বেঁচে আছেন কি না সেব্যাপারে কিছু বলতে পারছে না সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
গত ২১ জুলাই সাগরে নিম্নচাপের পর নিখোঁজ রয়েছেন ৫৪ জেলে। এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার লঘু চাপের পর থেকে আরও ২১ জেলে নিখোঁজ আছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন দেশের অন্যতম বড় মৎস্য বিক্রয় কেন্দ্র বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলা মৎস্য ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা বরগুনা ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে প্রায় তিন শতাধিক জেলে নিখোঁজ হন। গত কয়েক দিনে অধিকাংশ জেলেকে উদ্ধার করেছে কোস্ট গার্ড ও নৌ-বাহিনী, তবে ২১ জন এখন পর্যন্ত নিখোঁজ।
জুলাই থেকে নিখোঁজ জেলে
বরগুনা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মাহবুব আলম সোমবার বেনারকে বলেন, গত ২১ জুলাই সাগরে নিম্নচাপের পর ১ আগস্ট জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিখোঁজ জেলেদের ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
“সেই চিঠিতে আমরা বলেছি, উপজেলা পর্যায়ের তথ্য অনুসারে সেদিন সাতটি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। ওই ট্রলার ডুবির ঘটনায় ৫৪ জন জেলে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। আজ পর্যন্ত তাঁদের খবর পাওয়া যায়নি,” জানান তিনি।
মাহবুব আলম বলেন, “আমরা নিশ্চিত নই যে তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছে। তবে তাঁদের উদ্ধারে আমরা উপজেলা প্রশাসন, কোস্ট গার্ড ও অন্যান্য বাহিনীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি।”
মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ২১ জুলাই থেকে মরিয়ম ও হোসেন নামের দুটি ট্রলার নিখোঁজ রয়েছে।
এই নিম্নচাপ সম্পর্কে কোস্ট গার্ডের পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হামিদ বেনারকে বলেন, ওই ঘটনার পর কোস্ট গার্ডের দুটি জাহাজ হারিয়ে যাওয়া ট্রলার দুটিকে উদ্ধার করতে সাগরে যায়। তবে ট্রলার দুটিকে খুঁজে পায়নি।
বরগুনা জেলার পাথরঘাটার চল্লাখিমারা গ্রামের শাহীন ২১ জুলাই থেকে নিখোঁজ। তাঁর মা শাহীনুর বেগম বেনারকে বলেন, একমাত্র ছেলে হারিয়ে যাওয়ার দুই মাস দশ দিন আগে সাগরে মাছ ধরতে গিয়েছিল। তাঁর দুই মেয়ের একজনের বিয়ে হয়েছে। আর আরেকজন দশম শ্রেণিতে পড়ত।
এদিকে “সরকারের কেউ শাহীনের ব্যাপারে কিছু বলতে পারে না। সে বেঁচে আছে কি না সেটাও কেউ বলে না,” বলে বেনাররের কাছে মন্তব্য করেন শাহিনের স্ত্রী।
বৃহস্পতিবারের লঘু চাপ
বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলা মৎস্য ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বেনারকে বলেন, “আমাদের হিসাবে বৃহস্পতিবার থেকে তিন শতাধিক জেলে নিখোঁজ ছিল। কোস্ট গার্ড, নৌ-বাহিনী ও র্যাবের সহায়তায় অনেককেই উদ্ধার করা গেছে।”
তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার থেকে নিখোঁজ জেলেরা পাথরঘাটা এলাকার মানুষ। তাদের ব্যাপারে থানায় ডায়েরি করেছি।
বরগুনার জেলা প্রশাসক মোখলেসুর রহমান বেনারকে বলেন, গত বুধবার-বৃহস্পতিবারের নিম্নচাপের ঝড়ে অনেক ট্রলার বিভিন্ন চরে আটকা পড়ে। আবার কোনো কোনো ট্রলার অনেক দূরে চলে যায়।”
জেলা প্রশাসক বলেন, প্রায় সবাইকেই উদ্ধার করা গেছে। এখন পর্যন্ত কতজন জেলে নিখোঁজ তা বলা কঠিন। উদ্ধার কাজ চলছে।
তিনি বলেন, “নিখোঁজ জেলেরা আবার ফিরে আসে। তবে, আমরা নিখোঁজ প্রত্যেক জেলের পরিবারকে মাসে ত্রিশ কেজি চাল দিচ্ছি। আর তাদের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।”
কোস্ট গার্ডের মিডিয়া ফোকাল পয়েন্ট লেফটেন্যান্ট মারুফ বেনারকে বলেন, জেলেরা বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে সাগরে যায়। সুতরাং, কতজন জেলে মাছ ধরতে গিয়েছিল তা বলা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরের জলসীমা বিশাল। ঝড় আসলে জীবন বাঁচাতে জেলেরা বিভিন্ন চরে উঠে পড়ে। পরে তারা চলে আসে। আমাদের জাহাজ উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
মারুফ বলেন, আমাদেরকে অনেক সময় পরিবার সদস্য এবং নিকটাত্মীয়রা আটকে পড়া জেলেদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেন। তখন আমরা তাঁদের উদ্ধার করি।
তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে কৈখালী থেকে আটজন জেলেকে উদ্ধার করেছি।
পটুয়াখালী জেলার মহিপুর ঘাট মালিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন সোমবার বেনারকে বলেন, “বৃহস্পতিবার থেকে আমাদের এলাকার ১৬ জন জেলে নিখোঁজ ছিল। গতকাল আমরা খবর পেয়েছি, তাদের মধ্যে ১৫ জনকে ভারতীয় জেলেরা উদ্ধার করে ভারতের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। পরে তাদের জেলখানায় পাঠানো হয়েছে।”
তিনি বলেন, সামসুদ্দীন নামের এক জেলে নিখোঁজ রয়েছে। তার বাড়ি সিলেটে। আর সে বিয়ে করেছে কক্সবাজার জেলায়।
বৃহস্পতিবার আরও ১৫ জেলেকে ভারতীয় জেলেরা উদ্ধার করে পুলিশে সোপর্দ করেছে বলে জানিয়েছেন পাথরঘাটা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী। তাদের আলীপুর জেলে বন্দী রাখা হয়েছে।
নৌ-বাহিনীর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বৃহস্পতিবার থেকে আমরা উদ্ধার কাজ চালানোর সময় সাগরে দুই-তিনটি লাশ দেখেছি। তবে, লাশগুলো এমন অবস্থায় ছিল যে ওগুলো উদ্ধার করার মতো অবস্থায় ছিল না।
পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগর আগের চেয়ে অনেক বেশি উত্তাল থাকে। আবার সাগরে মৎস্য সম্পদ প্রতিদিন কমে আসছে। তাই জেলেরা মাছ ধরতে গভীর সাগরে যাচ্ছে। ফলে তারা বেশি ঝুঁকির মধ্যে সাগরে যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জলবায়ুর পূর্বাভাস কার্যকরভাবে জেলেদের কাছে পৌঁছাতে হবে।