ডলারের বাজার অস্থির, বড় ধাক্কা বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভেও

আহম্মদ ফয়েজ
2022.07.15
ঢাকা
ডলারের বাজার অস্থির, বড় ধাক্কা বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভেও দেশে পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় বহিনোঙ্গর থেকে পণ্য খালাসের শিডিউল না থাকায় কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতুরউজানে অলস বসে আছে লাইটার জাহাজগুলো। ২৯ জুন ২০২২।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশের মূদ্রা বাজারে সৃষ্টি হওয়া অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশে রেমিট্যান্স আয়ের পরিমাণ কমতে থাকা, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবরোধের জের ধরে অর্থনীতিতে নানামুখী সংকট দৃশ্যমান হচ্ছে।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় ডলারের বিপরিতে টাকার মান বার বার কমিয়েও সংকট মোকাবেলা করা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে, যা দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সরকার নানাভাবে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও বিদ্যমান অস্থির পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।

অর্থনীতির চলমান এই পরিস্থিতি সামাল দিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৪২ হাজার ৩০০ কোটি ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার ডলারের চাহিদা কমিয়ে আনতে পণ্য আমদানি তদারকি এবং অব্যবহৃত ডলার নগদায়নসহ কয়েকটি নতুন নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

একশ ছাড়িয়েছে ডলারের দাম

ঢাকার খোলা বাজারে ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী, বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ও মূদ্রা বিনিময় প্রতিষ্ঠানগুলো।

টাকার বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ডলারের মূল্য প্রায় ৯৪ টাকার মতো হলেও একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা বেনারকে জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলো একশ টাকার অধিক মূল্যে ডলার বিক্রি করেছে।

মতিঝিল এলাকার মূদ্রা-বিনিয়ম ব্যাবসায়ী মতিউর রহমান বেনারকে বলেন, “ক্রমবর্ধমান ডলারের চাহিদা সামাল দিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কিছুটা বেশি দামে খোলা বাজারে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে।”

রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকার ব্যাবসায়ী রেজাউল হাসান বেনারকে বলেন, “ঈদের আগেও ৯৬ থেকে ৯৭ টাকায় ডলার কিনলেও বৃহস্পতিবার আমাকে ডলার কিনতে হয়েছে ১০৩ টাকায়।”

বাংলাদেশ ব্যাংক বিক্রি করছে ডলার

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ১৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতি ডলারের দাম ধরা হয় ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা।

প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রির জেরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চার হাজার কোটি ডলারের নিচে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বেনারকে জানান, বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাঁচটি ব্যাংকর কাছে আন্তব্যাংক দরে ১৩৫ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে এবং তার আগে বুধবার তিনটি ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে ৯৭ মিলিয়ন ডলার।

ব্যাংকগুলোর ডলারের চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে দরে ডলার বিক্রি করে এবং ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে যে দামে লেনদেন করে সেটাই আন্তব্যাংক লেনদেন দর।

এই পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ টানা দ্বিতীয় দিনের মতো কমে ৩৯ দশমিক ৭০ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা বুধবার ছিলো ৩৯ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন ডলার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার অর্থনৈতিক অস্থিরতার জন্য রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধকে দায়ী করলেও বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, অতিরিক্ত বিদেশী ঋণ বাংলাদেশকে এই পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

অর্থনীতিবিদেরা বার বার সরকারকে বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতা কমানোর পরামর্শ দিয়ে আসছেন, যাতে করে বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতিতে না পড়তে হয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “আমরা এখনো ঋণ পরিশোধে ব্যার্থ হইনি এবং আমি অবশ্যই প্রত্যাশা করবো আমাদের যেন সেরকম অবস্থার দিকে যেতে না হয়।”

বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটিকে মহাসমস্যা বলা যাবে না।

“৪০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি রিজার্ভ মানে হচ্ছে, ছয় মাসের মতো রপ্তানি ব্যয় মেটানো যাবে। তিন-চার মাসের থাকলেও চলে। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো রিজার্ভ দ্রুত কমছে,” যোগ করেন এই অর্থনীতিবিদ।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, খবর বেরিয়েছে যে অর্থনীতির চলমান পরিস্থিতি সামাল দিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নিতে চায় বাংলাদেশ। প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ধরে হিসাব করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

তিনি বলেন, “অথচ ভর্তুকি কমানো, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও আর্থিক খাত সংস্কারের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি সরকারকেই সামাল দেয়ার কথা।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা সাময়িকভাবে স্বস্তিদায়ক হলেও অর্থনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধান নয় জানিয়ে আইএমএফের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, “আমাদের অবশ্যই আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে এবং ব্যাংক সূদের হার বাড়িয়ে স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটতে হবে।”

আইএমএফের এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি দল ৯ দিনের সফরে বৃহস্পতিবার ঢাকায় এসেছে। দলটি বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে আলাদা আলাদা বৈঠক করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের চার নির্দেশনা

ডলার সঙ্কট নিরসনে করে অর্থনীতিতে চাঙা ভাব ফেরাতে বৃহস্পতিবার নতুন চারটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে; ব্যাংকের ডলার ধারণের সীমা (এনওপি) হ্রাস, রপ্তানিকারকের প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) ধারণকৃত ডলারের ৫০ শতাংশ নগদায়ন, ইআরকিউ হিসাবে জমা রাখার সীমা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা এবং অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ইউনিটে স্থানান্তরের সুযোগ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ৫০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের বেসরকারি যেকোনো আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হবে।

বর্তমানে ব্যাংকগুলো রেগুলেটরি ক্যাপিটালের ২০ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণ করতে পারে। এই সীমা ১৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অপরদিকে রপ্তানিকারকের প্রত্যাবাসন কোটা (ইআরকিউ) হিসাবে জমাকৃত বৈদেশিক মুদ্রার ৫০ শতাংশ দ্রুত নগদায়ন করার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, আগামী ছয় মাস ব্যাংকগুলো তাদের রেগুলেটরি মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশের সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা অফশোর ইউনিট থেকে অভ্যন্তরীণ ইউনিটে নিতে পারবে।

অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো বিদেশি মুদ্রায় আমানত নেয়, বিদেশ থেকে ঋণও নেয়। তবে এই অর্থ দিয়ে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকের আমদানি দায় শোধ করা যায় না।

রাজনীতিতে সমালোচনা

অর্থনৈতিক এই পরিস্থিতি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে চলছে পারষ্পরিক দোষারোপের রাজনীতি। বিরোধী দলীয় উপনেতা ও জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের শুক্রবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ঋণের দায়ে বাংলাদেশ দেউলিয়া হতে পারে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির মধ্যে মিল দেখতে পাচ্ছেন। শ্রীলঙ্কাও ঋণের বোঝা টানতে গিয়ে দেউলিয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী দলের বিএনপির নেতারাও বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করে বক্তব্য দিচ্ছেন।

তবে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ শুক্রবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা এক নয়। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে। তাঁর মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।  

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।