অস্থির ডলারের বাজার সামাল দিতে এবার অভিযান
2022.07.29
ঢাকা

বৈশ্বিক অর্থনীতির বৈরি পরিস্থিতিতে ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রনে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে কোন কিছুতেই স্বাভাবিক করা যাচ্ছে না বাজার।
বার বার বৈদেশিক মূদ্রার রির্জাভ থেকে খোলা বাজারে ডলার ছেড়েও মিলছে না সমাধান। উল্টো কমছে রির্জাভের পরিমান, বাড়ছে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম।
এমন পরিস্থিতে বাজার নিয়ন্ত্রনে এবার মাঠে নেমেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। খোলা বাজারে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সপ্তাহের শেষ দুই দিন বিভিন্ন মানি চেঞ্জার পরিদর্শন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের দশটি পৃথক টীম।
পাশাপাশি অবৈধভাবে ডলার মজুতকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।
ব্যাংকে ডলারের সংকট কাটাতে সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে রিজার্ভ কমে দাড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৪৭ কোটি ডলারে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “ডলারের বাজার পরিস্থিতি বুঝে যখন, যেভাবে প্রয়োজন সেভাবে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।”
তিনি জানান, গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় মানি চেঞ্জার পরিদর্শন চালু করায় বিভিন্ন অনিয়ম ধরা পড়ছে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তিনি বলেন, আমদানি বিল পরিশোধের জন্য বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর চাহিদার ভিত্তিতে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব মতে, চলতি অর্থ বছরের প্রথম মাসেই ১০০ কোটির বেশি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
খোলা বাজার বা কার্ব মার্কেটে বৃহস্পতিবার ডলারের দাম ছিলো ১১০ টাকা থেকে ১১২ টাকার মধ্যে।
ছাপাখানার সরঞ্জাম আমদানি ব্যবসায়ি মাহমুদুল হাসান রাজু বেনারকে বলেন, বৃহস্পতিবার তিনি রাজধানীর মতিঝিল এলাকার একটি মানি চেঞ্জার হাউজ থেকে ১১১ টাকা মূল্যে ডলার ক্রয় করেছেন।
তিনি বলেন, “মানি চেঞ্জার ব্যবসায়ীরা প্রায় প্রতিদিনই ডলারের দাম বাড়াচ্ছে, যার ফলে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।”
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছেন, ডলার কারসাজিতে যাঁরাই জড়িত থাকুক না কেন, তাঁদের শক্ত হাতে ধরা দরকার।
“দেশে ব্যাংকগুলোকে ব্যবসা করার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ১ ডলারে ১০ টাকা মুনাফা করার লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৯৪ টাকায় ডলার দেবে, আর অন্যান্য ব্যাংক তা ১০৫-১১০ টাকায় বিক্রি করবে, আমরা তা চাই না,” যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকরে মুখপাত্র জানান, এফবিসিসিআই নেতার এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে গভর্নর জনিয়েছেন, ডলারের দাম বাড়িয়ে যেসব মানি চেঞ্জার ও ব্যাংক মুনাফা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাঠে নামার ঘোষণা ডিবির
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ জানিয়েছে, ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অবৈধভাবে কেউ ডলার মজুত করলে, ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, “আমরা সব সময় তৎপর। বর্তমানে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির এ সময়টিতে কেউ অবৈধভাবে ডলার মজুদ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
এছাড়া ডলারের তীব্র চাহিদা কাজে লাগিয়ে বাজারে জাল ডলার ছাড়তে প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা যদি কোনো তথ্য পাই কেউ ডলার মজুদ করছেন বা জাল ডলার তৈরির সরঞ্জাম অথবা মেশিন আছে, তাহলে অবশ্যই অভিযান পরিচালনা করা হবে।”
বাংলাদেশে ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যথাযথ নিয়ম ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংরক্ষণ করতে পারেন না। বিদেশ গমনের উদ্দেশ্য থাকলে নিয়ম মেনে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ডলার একজন ব্যক্তি রাখতে পারেন।
নিয়ম না মেনে বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণ করা বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মির্জা বদিউজ্জামান টিপু বেনারকে বলেন, “বাড়তি দামে ডলার বিক্রির অভিযোগ সত্য নয়। বাজার অস্থিতিশীল থাকায় বিভিন্ন পক্ষ এখন এই খাতের ব্যবসায়ীদের দিকে আঙুল তুলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান সম্পর্কে তিনি বলেন, “এসব অভিযান বাজারকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলেছে। অনেক ব্যবসায়ী অফিস খুলছে না। কেউই নিজের টাকায় ব্যবসা করতে এসে বাড়তি ঝামেলায় জড়াতে চায় না।”
বার বার রিজার্ভে হাত দেয়া বিপদজনক: অর্থনীতিবিদ
ডলারের চাহিদা সামাল দিতে গিয়ে বার বার রিজার্ভের ডলার খরচ করাকে বিপদজনক বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
তাঁদের মতে, সংকট মোকাবেলায় রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ালে তা ভবিষ্যতে দেশকে বিপদগ্রস্ত করে তুলতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বেনার বলেন, “আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়েই এখন রিজার্ভ ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না এবং ব্যাংকগুলো নিয়মিত এলসি খুলতেও পারছে না। ডলারের সংকট প্রতিনিয়ত তীব্র হচ্ছে। এই অবস্থায় রেমিট্যান্স বাড়ানোর বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।”
রপ্তানি আয় বাড়িয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলেও এই মুহুর্তে রপ্তানির বড় বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। তাই রপ্তানি বাড়ানো বেশ কঠিন হবে জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “এই পরিস্থিতিতে রপ্তানি বরং কমে যাবে। ফলে রপ্তানি থেকে আয় বাড়ার সম্ভাবনা কম।”
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, “সরকারকে অবশ্যই দীর্ঘ মেয়াদী উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন খাতে যে পরিমান ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে তা কমিয়ে আনতে হবে।”
আমদানি ব্যয় যেভাবে বাড়ছে এবং প্রবাসী আয় যেভাবে কমছে, তাতে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে না নিলে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সহজ হবে বলে মনে করেন না এই অর্থনীতিবিদ।
রিজার্ভের ডলার বার বার বিক্রি করা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা উদ্বেগ জানিয়ে আসলেও রিজার্ভ নিয়ে উৎকণ্ঠার কারণ নেই জানিয়ে গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে ৯ মাসের খাদ্যশস্য আমদানি করা যাবে।
“আমাদের এখন যে রিজার্ভ আছে, তাতে ৩ মাস কেন ৬ মাস, ৯ মাসের খাবারও আমরা কিনে আনতে পারব। কিন্তু আমাদের সেই পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে খাদ্যশস্য কিনতে না হয়। আমরা যেন নিজেরা উৎপাদন করতে পারি।” বলেন প্রধানমন্ত্রী।