বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্তের কাছে বিজিবির গুলিতে দুই রোহিঙ্গা নিহত
2021.02.08
কক্সবাজার

বান্দরবান জেলার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে দুই রোহিঙ্গা শরণার্থী নিহত হয়েছেন, যারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
তবে রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, বড়ি বহনকারীরা ধরা পড়লেও ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত গডফাদারেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
শরণার্থীদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাস্টার মোহাম্মদ ইলিয়াছ বেনারকে বলেন, “যারা মারা যাচ্ছে, বেশিরভাগই ইয়াবা বহনকারী। মাদকের গডফাদারেরা আড়ালে থাকে, মারা যায় বহনকারী। অল্প কিছু টাকার জন্য তারা এই কাজ করছে।”
গডফাদারদের মধ্যে বেশিরভাগ বাংলাদেশি—এমন দাবি করে তিনি বলেন, “তবে কিছু কিছু রোহিঙ্গাও গডফাদার হয়ে উঠেছে।”
“আমরা যতটুকু শুনেছি, ওপার (মিয়ানমার) থেকে মগেরা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে এনে ইয়াবার চালান বহনকারীদের হাতে তুলে দেয়। সেখান থেকে তা নিয়ে আসার সময় মাঝে মাঝে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে,” বলেন মাস্টার ইলিয়াছ।
সোমবার ভোরে বিজিবির সঙ্গে ক্রসফায়ারে নিহতরা হলেন, উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের মোহাম্মদ ফোরকানের ছেলে মো. জোবায়ের (২৮) ও মৃত আমির হামজার ছেলে দিল মোহাম্মদ (২৫)।
মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড়ো চালান আসার খবর পেয়ে বিজিবির দুটি দল সীমান্তে অভিযান চালিয়েছে উল্লেখ করে কক্সবাজারের ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ বেনারকে বলেন, “গভীর রাতে পাঁচ-ছয়জন ইয়াবা পাচারকারী সীমান্ত অতিক্রম করে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের গর্জনবনিয়ার চাকমাপাড়া এলাকায় পৌঁছে।”
“তারা বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় আমাদের সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালায়। পরে তল্লাশি চালিয়ে দুজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে পার্শ্ববর্তী উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন,” বলেন তিনি।
ওই ঘটনার সময় আহত বিজিবির দুই সদস্যকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বলে বিজিবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়।
নিহতদের কাছ থেকে এক লাখ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, দুটি দেশীয় একনলা বন্দুক, চারটি তাজা গুলি এবং ঘটনাস্থল থেকে দুটি গুলির খোসা পাওয়ার কথাও জানান এই কর্মকর্তা।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “বেশ কয়েক বছর ধরেই আমরা লক্ষ করছি, একের পর এক রোহিঙ্গা শরণার্থী বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছে, এবং প্রতিটি ঘটনাতেই আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো একই ধরনের গৎবাঁধা বক্তব্য দিচ্ছে। এর একটা বিহিত হওয়া উচিত।”
কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মৃত্যুর পর সারা দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা কমে যায়। ওই ঘটনার পর এই দুজনসহ মোট পাঁচজন রোহিঙ্গা ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেলেন।
জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে একইভাবে ঘুমধুম সীমান্তের দক্ষিণ বাইশফাঁড়ি এলাকায় নিহত হন কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা মো. আব্দুর রহিম (২৫)। তখনও ঘটনাস্থল থেকে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা, একটি দেশীয় দুই নলা বন্দুক এবং চারটি কার্তুজ উদ্ধার করার কথা জানিয়েছিল বিজিবি।
এর আগে গত নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এবং ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে আরও দুইজন রোহিঙ্গা একইভাবে মারা যান।
আসকের দেওয়ার হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৪৫ এবং ২০১৯ সালে ৪৯ জন রোহিঙ্গা বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
লিটন বলেন, “এই হিসাব প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে তৈরি। কিন্তু সব ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসে না। যে কারণে প্রকৃত ঘটনার সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
“এটা ভুলে গেলে চলবে না যে রোহিঙ্গারা এখানে আশ্রিত। তাদের মধ্যে কেউ যদি অপরাধের সাথে যুক্ত হয়েও যায়, তাকে আইনসম্মতভাবে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে জীবনহানির ঘটনা এড়িয়ে শাস্তি দিতে হবে,” যোগ করেন মানবাধিকার কর্মী লিটন।
গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে নয়টার দিকে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের চেকপোস্টে টেকনাফ পুলিশের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা।
আসকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে মোট ২২২ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে জুলাই পর্যন্ত মারা গেছেন ২১০ জন। অর্থাৎ সিনহা হত্যার পর ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে ১২টি।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জল ও স্থলভাগের বিভিন্ন পয়েন্টে মাদক চোরাচালান হচ্ছে স্বীকার করলেও টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়সাল হাসান খান বেনারকে বলেন, “বিজিবির তৎপরতায় অসংখ্য ইয়াবা কারবারি বিজিবির হাতে ধরা পড়ছে। আবার অনেক বন্দুকযুদ্ধেও মারা যাচ্ছে।”
তাঁর দাবি, চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সোয়া ১২ কোটি টাকার মূল্যের চার লাখ ৬২ হাজার ৩৮২ পিস ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করেছে বিজিবি। এ ছাড়া গত তিন বছরে তারা প্রায় সাড়ে পাঁচশ কোটি টাকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। যার মধ্যে ছিল এক কোটি ৭৭ লাখ ৭৫ হাজার ৬২৫ পিস ইয়াবা।
ডাকাত দলের সদস্য আটক
আলোচিত রোহিঙ্গা ডাকাত দল জকির গ্রুপের দুই সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১৫)। কক্সবাজারের টেকনাফের কেরুনতলী সংলগ্ন সাইরংখাল এলাকায় সোমবার অভিযান চালিয়ে একটি দেশীয় অস্ত্রসহ তাঁদের আটক করা হয়।
র্যাব-১৫ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) এএসপি আবদুল্লাহ মোহাম্মদ শেখ সাদী জানান, গ্রেপ্তারকৃত মো.আলম (৩৫) টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়ার মৃত তৈয়ব আলীর ছেলে এবং মো. আজিম (২০) মৌচানি রোহিঙ্গা শিবিরের মোহাম্মদ রেদোয়ানের ছেলে।
অনুপ্রবেশের শঙ্কা নেই
টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক জানিয়েছেন, মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান হলেও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের মতো কোনো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়নি। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম শনিবার শাহপরীর দ্বীপে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত জলসীমা পরিদর্শনের পর তিনি এ নিয়ে কথা বলেন।
“আমরা মিয়ানমার পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি। এখনও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি,” বলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়সাল।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে শরীফ খিয়াম।