কোটা আন্দোলনের নেতা নুরুল হক ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত

জেসমিন পাপড়ি
2019.03.11
ঢাকা
190311_DUCSU_ELECTION_1000.jpg পুনরায় ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোট বর্জনকারীদের বিক্ষোভ। ১১ মার্চ ২০১৯।
[নিউজরুম ফটো]

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ছাড়া সকল প্যানেল ও স্বতন্ত্র শিক্ষার্থীদের বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের  নেতা নুরুল হক নূর ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রলীগের গোলাম রাব্বানী।

সোমবার দিবাগত রাতে সিনেট ভবনে এ ফল ঘোষণা করেন ভিসি ড. মো. আখতারুজ্জামান।

ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে ভিপি পদ ছাড়া বাকি সবকটি পদে বিজয়ী হয়েছেন ছাত্রলীগের প্রার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের মধ্যে ভিপি পদে ১২টিতে ছাত্রলীগের ও ৬টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ১৪টিতে ছাত্রলীগ ও বাকি চারটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। ছাত্রীদের পাঁচ হলের চারটিতে ভিপি ও তিনটিতে জিএস পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।

এদিকে নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এনে পুনঃনির্বাচনের দাবি জানিয়েছে ভোট বর্জনকারীরা। পাশাপাশি মঙ্গলবার থেকে ধর্মঘটের ডাকও দেওয়া হয়। এ সময় ক্লাস বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে তারা।

বিরোধীদের ভোট বর্জন

সোমবার দুপুর একটার দিকে ভোটগ্রহণের শেষ পর্যায়ে মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলন করে যৌথভাবে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ, স্বতন্ত্র জোট এবং ছাত্র ফেডারেশন। পরে পৃথক সংবাদ সম্মেলনে একই সিদ্ধান্তের কথা জানায় ছাত্রদলও।

তবে উৎসবমুখর পরিবেশে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে বলে দাবি করেছেন ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলাবোধ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। …এ নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা সামনের দিনগুলোতেও গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি নতুন মাত্রায় এগিয়ে নেওয়ার অনুপ্রেরণা পাচ্ছি।”

অন্যদিকে সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নির্বাচনের পরিবেশ নেই অভিযোগ করে বামজোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী বলেন, “আমরা এই প্রহসনের নির্বাচন, জালিয়াতির নির্বাচন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।”

“প্রশাসনকে এই ভোট বাতিল করে পুনরায় তফসিল ঘোষণার পাশাপাশি এই ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে,” বলেন তিনি।

এ সংবাদ সম্মেলনে সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের এজিএস প্রার্থী ফারুক হাসান, ছাত্র ফেডারেশনের জিএস প্রার্থী উম্মে হাবিবা বেনজীর, স্বতন্ত্র জোটের ভিপি প্রার্থী অরণি সেমন্তী খান এবং স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদের জিএস প্রার্থী এ আর এম আসিফুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সকাল আটটা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি হলে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। তবে সোমবার ব্যালট বাক্স সিলগালা করা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও প্রভোস্টের বাদানুবাদে রোকেয়া হলে ঘণ্টাখানেক দেরিতে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। আর বস্তাভর্তি ব্যালট পেপার উদ্ধারের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের পর বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ভোট শুরু হয় তিন ঘণ্টা দেরিতে।

২৮ বছর পরে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সংসদ ও হল সংসদের ভোট অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচন চেয়ে উচ্চ আদালতে করা রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে এ নির্বাচনের উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এবার ডাকসু নির্বাচনে ২৫ পদের বিপরীতে মোট ২২৯ জন প্রার্থী ছিলেন। এ ছাড়া ১৮টি হল সংসদে ১৩টি করে ২৩৪টি পদে বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন ৫০৯ জন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোট বর্জনকারীদের বিক্ষোভ। ১১ মার্চ ২০১৯।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোট বর্জনকারীদের বিক্ষোভ। ১১ মার্চ ২০১৯।
[নিউজরুম ফটো]

উত্তাল ক্যাম্পাস

ডাকসু নির্বাচনে অনিয়ম ও জালভোটের অভিযোগ তুলে পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে চলছে বিক্ষোভ মিছিল। ভোট বর্জনকারীরা উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনেও অবস্থান নিয়েছে। ক্যাম্পাসে মোতায়েন করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক পুলিশ।

নির্বাচন বাতিল না করা পর্যন্ত ভিসি কার্যালয়ের সামনে অবস্থানের ঘোষণাও দিয়েছে নির্বাচন বর্জনকারীরা। সোমবার বিকেলে প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. এস এম মাহফুজুর রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ করে এসে এ ঘোষণা দেন তাঁরা।

আন্দোলনকারীদের লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদানে বাধা দান, অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট কেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া, কারচুপি, প্রার্থীদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা, ভোট বাক্স নিয়ে লুকোচুরি, ভোট দেওয়ার পরও লাইনে দাঁড়িয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করাসহ বিভিন্ন অনিয়ম হয়েছে।

এরই প্রেক্ষাপটে তাঁরা ভোট বর্জন করেছেন উল্লেখ করে জানান, “এ প্রহসনের নির্বাচন বাতিল করে অবিলম্বে নির্বাচনের পুনঃতফসিল ঘোষণা করতে হবে। কোনোক্রমেই এই প্রহসনের নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করা যাবে না।”

ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের উপস্থিতিতেই রোকেয়া হলে সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্যানেলের ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নূরু এবং নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নারী প্রার্থীরা হামলা চালায় বলেও অভিযোগ করা হয়।

“আমরা সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দলকানা প্রশাসনের একপক্ষীয় আচরণ, রাতভর কুয়েত মৈত্রী হলে ব্যালটে ভোট প্রদান, বিভিন্ন প্রার্থীর ওপর হামলা ও ভোটারদের বাধা দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদে ভোট বর্জন করলাম,” পৃথক সংবাদ সম্মেলনে বলেন ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান।

এদিকে নতুন ভোটের দাবি হাস্যকর বলে মন্তব্য করেছেন ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন।

সোমবার বিকেলে মধুর ক্যানটিনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “অনেকে নতুন করে ভোটের কথা বলছেন। এ দাবি হাস্যকর। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিবেচনা করতে চাইলে সেটা তাঁদের ব্যাপার। আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে, তাই আমরা নিয়ম মেনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি।”

ডাকসু নির্বাচন বানচাল করার জন্য আগের রাতেই ষড়যন্ত্র হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আজ তার সফল মঞ্চায়ন হয়েছে।”

ছাত্র ইউনিয়নের লিটন নন্দী, কোটা আন্দোলনের নুরুল হক নুরু ও ছাত্রদলের অনিক এ ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ডাকসু নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই কুয়েত-মৈত্রী হলে পাওয়া সিল দেওয়া ব্যালট নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ১১ মার্চ ২০১৯।
ডাকসু নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই কুয়েত-মৈত্রী হলে পাওয়া সিল দেওয়া ব্যালট নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ১১ মার্চ ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

ভোটের আগেই বস্তা ভর্তি ব্যালট

ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই কুয়েত-মৈত্রী হলের শিক্ষার্থীরা বস্তাভর্তি ব্যালট নিয়ে বের হয়ে আসেন। তাঁদের বিক্ষোভের মুখে হলের ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষকে সরিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চার সদস্যের একটি ‘তথ্যানুসন্ধান কমিটি’ গঠন করা হয়।

“কুয়েত মৈত্রী হলের ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব থেকে ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক ড. শবনম জাহানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাঁর পরিবর্তে ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীনকে ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ করা হয়েছে,” সাংবাদিকদের জানান প্রক্টর গোলাম রব্বানী।

কুয়েত মৈত্রী হলের একাধিক প্রার্থী বেনারকে জানান, “ভোট শুরুর আগেই হলের রিডিং রুমে বসে ব্যালটে সিল মারছিল।”

এসব ব্যালটে আগের রাতেই ছাত্রলীগের হল প্যানেলের প্রার্থীদের ভোট দেওয়া হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান তাঁরা।

ডাকসুর জিএস পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী আসিফুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “উদ্ধার হওয়া সবগুলো ব্যালটে একই প্যানেলের প্রার্থীর নামে ভোটের চিহ্ন দেওয়া। এগুলো আগের রাতেই মেরে রাখা হয়েছে।”

নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজুর জানান, নির্ধারিত সময়ের তিন ঘণ্টা পর কুয়েত-মৈত্রী হলে ভোটগ্রহণ শুরু হয়।

রোকেয়া হলের একটি কক্ষেও ট্রাংকভর্তি ব্যালট পেপার পাওয়ার পর সেগুলো ছিনিয়ে নিয়ে যায় এ হলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকেরা। ফলে এক ঘণ্টা ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে।

রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ফারহানা ফেরদৌসী সাংবাদিকদের বলেন, “ভোটগ্রহণ কক্ষের পেছনে কন্ট্রোল রুমে একটি একটি ট্রাংকে ব্যালট পেপার রাখা ছিল। এই ব্যালট পেপারে আগে থেকে সিল মারা ছিল বলে ছাত্রীদের অভিযোগ। পরে তারা সেগুলো নিয়ে যাওয়ায় আমরা ভোটগ্রহণ স্থগিত করি।”

তবে সিল মারা ব্যালট থাকার অভিযোগ ‘গুজব’ দাবি করে ছাত্রলীগের জিএস প্রার্থী গোলাম রব্বানী বলেন, “যারা এ গুজব ছড়িয়েছে তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ কোনো প্রমাণও দিতে পারেনি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।