দুর্গাপূজার উৎসবে মেতেছে বাংলাদেশ ও ভারত

পরিতোষ পাল ও পুলক ঘটক
2019.10.04
কলকাতা ও ঢাকা
191004_Durga_Puja_1000.JPG ঢাকায় একটি দুর্গপূজার মণ্ডপ। ৪ অক্টোবর ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং ত্রিপুরা রাজ্যে মহাসমারোহে শুরু হয়েছে বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা।

“পূজায় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা যথাযথভাবে পালিত হলে শান্তি ও উৎসবের মধ্য দিয়েই সারাদেশে এই উৎসব সম্পন্ন হবে,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাসগুপ্ত।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম শুক্রবার বেনারকে বলেন, “শারদীয় দুর্গোৎসবে নাশকতার কোনো আশঙ্কা নেই। তারপরও আমরা সর্বত্র সজাগ দৃষ্টি রেখেছি।”

“প্রতিটি মণ্ডপের নিরাপত্তায় আলাদা ফোর্স মোতায়েন থাকবে। কোথাও হামলা বা অনাকাঙ্খিত ঘটনা হলে তা মোকাবিলায় পুলিশের পরিপূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে,” বলেন তিনি।

দেশের প্রতিটি পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা রক্ষায় পুলিশ, আনসার, র‍্যাব ও বিডিআর সদস্যদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে।

বর্ণিল আলোকসজ্জায় সেজে উঠা পূজামণ্ডপগুলোতে বৃহস্পতিবার দুর্গা দেবীর বোধন এবং শুক্রবার ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনব্যাপী উৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। আগামী ৮ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই শারদোৎসব।

দুর্গোৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। শুক্রবার পূজার উদ্বোধনী দিনেই রাজধানীর কেন্দ্রীয় আয়োজন ঢাকেশ্বরী পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করেন রাষ্ট্রপতি।

বাংলাদেশে মণ্ডপের সংখ্যা বেড়েছে

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জি বেনারকে জানান, এবার সারা দেশে ৩১ হাজার ৩৯৮টি পূজামণ্ডপে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা গত বছরের চেয়ে ৪৮৩টি বেশি।

তিনি বলেন, “মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা রয়েছে। সরকার সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিজে মন্দিরে এসে হিন্দু সমাজের মানুষের প্রতি উৎসাহ যোগাচ্ছেন।”

দুর্গোৎসব চলাকালে প্রতিদিনই পূজার অঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ ও ভোগ-আরতির আয়োজন করা হবে। এছাড়া মণ্ডপে মণ্ডপে আলোকসজ্জা, আরতি প্রতিযোগিতা, স্বেচ্ছায় রক্তদান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, নাটক, নৃত্যনাট্যসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন রয়েছে।

১১ জেলায় প্রতিমা ভাংচুর

এদিকে বৃহস্পতিবার ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মহানগর সার্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দ বলেছেন, উৎসব শুরুর আগেই এবার ১১ জেলায় প্রতিমা ভাংচুরের ১৩টি ঘটনা ঘটেছে।

মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক কিশোর রঞ্জন মন্ডল বলেন, “এবারও উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্নস্থানে কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে। আগামীতে এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে সেজন্য সকলকে সজাগ থাকার আহ্বান জানাই।”

সুষ্ঠুভাবে পূজা সম্পন্ন করতে মহানগর এলাকার মন্দিরগুলোর প্রতি কিছু নির্দেশনা দিয়েছে কমিটি। প্রতিটি মণ্ডপে কমপক্ষে ১০জন নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবকের ২৪ ঘণ্টা তদারকি ও পাহারার ব্যবস্থা, আতশবাজি ও পটকা না ফোটানো, ৮ অক্টোবর রাত দশটার মধ্যে বিসর্জন সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।

কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের পূজামণ্ডপে মানুষের ঢল। ৪ অক্টোবর ২০১৯।
কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের পূজামণ্ডপে মানুষের ঢল। ৪ অক্টোবর ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

পশ্চিমবঙ্গে ৩৩ হাজার মণ্ডপ

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে এ বছর ৩৩ হাজারের বেশি সর্বজনীন দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। কলকাতাতেই আড়াই হাজার মণ্ডপে পূজা হচ্ছে। এর মধ্যে বড় পূজা ১৮০টি। এছাড়াও হাজারেরও বেশি বনেদি বাড়িতে হচ্ছে পারিবারিক দেবী আরাধনা।

পূজা উপলক্ষে কলকাতায় কঠোর পুলিশি বন্দোবস্ত করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের বলেছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা।

তিনি বলেন, “পূজার পাঁচদিন প্রায় ২২ হাজার পুলিশ ভিড় নিয়ন্ত্রণের কাজ করবে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে একশটি মণ্ডপ ও রাস্তার মোড়ে সিসিটিভি লাগানো হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে ৪৬টি ওয়াচ টাওয়ার।”

বনেদিয়ানা বনাম থিম পূজা

“পশ্চিমবঙ্গের পূজায় চলছে বনেদিয়ানা বনাম থিম পূজার লড়াই। গত কয়েক বছরে থিম পূজার প্রচলন হওয়ার পর তা এখন গ্রাম বাংলাতেও ছড়িয়ে পড়েছে,” বেনারকে বলেন অধ্যাপক শাশ্বত মুখোপাধ্যায়।

তিনি বলেন, “বনেদি বাড়ি ও উত্তর কলকাতার কিছু বারোয়ারি পূজামণ্ডপে সাবেকি রীতি অনুযায়ী একচালায় ডাকের সাজে, সোলা কাজে দেবীর আরাধনা হয়। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতায় থিম পূজার নানা বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য মণ্ডপ তৈরিতে, প্রতিমাতেও। থিমের মাধ্যমে নানা সামাজিক বার্তাও দেওয়া হচ্ছে।”

এবার মেয়েরাও মূর্তি তৈরিতে হাত লাগিয়েছেন। বেহালার একটি পূজামণ্ডপ ও মূর্তি তৈরি করেছেন শিল্পী উপাসনা চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “আমি দেবীকে একজন গৃহিনী থেকে অশুভ শক্তির নিধনকারী হিসেবে তুলে ধরেছি।”

থিম পূজা প্রচলন সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষ খুশি হলেও প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও সমাজ কর্মী মীরাতুন নাহার বেনারকে বলেন, “এখন কেমন কৃত্রিমতা গ্রাস করেছে পূজাকে। আগে আমরা পূজায় যে আন্তরিকতা উপলব্ধি করতাম এখন আর তা নেই। এখন দুর্গাপূজা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, রাজনীতিও ঢুকে পড়েছে।”

তবে ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে এখন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও বারোয়ারি দুর্গাপূজায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন।

কলকাতা লাগোয়া বারুইপুরের এক পূজা উদ্যোক্তা সেলিম হোসেন বেনারকে বলেন, “মানুষের ধর্ম একটাই, মনুষ্যত্ব। কে হিন্দু, কে মুসলমান তার চেয়েও বড় কথা আমরা একে অপরের উৎসবে যাতে শান্তিতে ও আনন্দে থাকতে পারি।”

মুর্শিদাবাদের কান্দির জনপ্রতিনিধি (বিধায়ক) সফিউল আলম খান নিজের হাতেই দুর্গা মূর্তি গড়েন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।