অনলাইন কেনাবেচা: পণ্য সরবরাহের আগে টাকা না দেওয়ার পরামর্শ
2021.06.24
ঢাকা

ক্রেতাদের কাছে পণ্য হস্তান্তরের আগে টাকা নিতে পারবে না ই–ভ্যালির মতো অনলাইন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। এ ছাড়া ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সার্বিক লেনদেনও নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বৃহস্পতিবার বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা’ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক যৌথ সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভা শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান।
হাফিজুর রহমান জানান, “পণ্য ডেলিভারির আগে টাকা পরিশোধ যেন না হয়, সেজন্য খুব শিগগির বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে একটি পরিচালন নির্দেশিকা (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর–এসওপি) সার্ভিস তৈরি করা হবে। ব্যাংক বা ক্রেডিট কার্ড যাদের আছে, তারা পেমেন্ট কন্ট্রোল করবে। পণ্য ডেলিভারির পর মেসেজ পেলে সেই টাকা নিশ্চিত করা হবে।”
ই–ভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতাদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেছেন, “যারা অস্বাভাবিক অফার দেয়, তারা সন্দেহজনক আচরণ করতে পারে। তাই ক্রেতারা যেন অনলাইনে কার্ড বা বিকাশ-নগদের মতো সিস্টেমে পেমেন্ট করে। তাহলে পেমেন্ট কন্ট্রোল করা যাবে। এর বাইরে কোনো ক্রেতা অগ্রিম টাকা দিলে সমস্যা হতে পারে।”
উল্লেখ্য, সম্প্রতি নজরদারির বাইরে থাকা ই-কমার্স সাইটগুলোয় উচ্চ মাত্রায় আর্থিক লেনদেনের ঝুঁকির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি প্রতিবেদন পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া অগ্রিম অর্থের তুলনায় এসব প্লাটফর্মের দৃশ্যমান তেমন কোনো সম্পদ না থাকার বিষয়টি এতে তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অনলাইনভিত্তিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান (ই-কমার্স) ই–ভ্যালির চলতি সম্পদের পরিমাণ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির দেনার পরিমাণ ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সম্পদের চেয়ে ছয় গুণ বেশি এই দেনা পরিশোধ করার সক্ষমতা কোম্পানিটির নেই।
বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর গত দুই দিন ধরে কেনাকাটার অনলাইন প্লাটফরমগুলোতে লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থান নেয় বিভিন্ন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
গ্রাহকদের সতর্ক করল ব্যাংক
বুধবার ব্র্যাক ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়ার পর বৃহস্পতিবার ঢাকা ব্যাংক ঘোষণা দিয়ে ১০ টি ই-কমার্স সাইটে ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডে কেনাকাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও গ্রাহকদের ক্ষুদেবার্তা পাঠানোসহ নানাভাবে সতর্ক করেছে।
এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে কার্ড ব্যবহার করে লেনদেন বিষয়ে গ্রাহকদের সতর্ক করেছে ইউসিবি, সিটি ব্যাংক এবং লংকাবাংলা ফাইন্যান্স।
লংকাবাংলা ফাইন্যান্স গ্রাহকদের বার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছে, লংকাবাংলার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কোনো লেনদেন করলে এর দায়ভার তারা বহন করবে না।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বেনারকে বলেন, “ই-কমার্স পরিচালনার ব্যাপারে দেশে এখনো নীতিমালা নেই। যার ফলে কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। আমরা ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে একটি খসড়া পলিসি প্রস্তাবনা আকারে সরকারের কাছে দিয়েছি, সেটা এক বছর আগের কথা। এখন সরকার উদ্যোগী হচ্ছে।”
“আসলে এই খাতের জন্য সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। তাতে স্বচ্ছতা, শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে,” জানান আব্দুল ওয়াহেদ।
তাঁর মতে, “নীতিমালা হলে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয় পক্ষের লাভ হবে। মানুষের আস্থা বাড়লেই ই-কমার্স আরও বিকশিত হবে।”
এদিকে এমএলএম কোম্পানির মতো ঝুঁকিতে থাকা ই-কমার্সের কোনো প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা পালিয়ে যেতে পারেন কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে হাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, “এ ব্যাপারে সভায় আলোচনা হয়নি। বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।”
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তাদের কাছ থেকে জামানত রাখার সিদ্ধান্ত আছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়েও আলোচনা হয়নি।
ই–ভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর বা ভ্যাট ফাঁকির কোনো অভিযোগ আছে কি-না জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ট্যাক্স সংক্রান্ত কিছু ছিল না। তাদের সম্পদের চেয়ে দায় বেশি—এই ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”
তিনি বলেন, “আমরা একটি এসওপি ডেভেলপ করছি, সেটি অনুসরণ করার জন্য সবাইকে বলা হবে। এ ছাড়া দেশে পেনাল কোড, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ প্রচলিত অনেকগুলো আইন আছে, যা দিয়ে প্রতারকদের ধরা সম্ভব।”
সম্পদের চেয়ে দেনা বেশি
সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব অনলাইন মার্কেট প্লেস সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে এসব ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে উচ্চ লেনদেনের বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রতিবেদন তৈরি করে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনলাইন ক্রেতাদের লোভনীয় সব ছাড়ের ফাঁদে ফেলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো বিশাল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করছে, যা উদ্বেগজনক।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ক্রেতাদের কাছ থেকে সংগৃহীত অগ্রিম অর্থের বিপরীতে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পদ নেই। অর্থাৎ সম্পদের চেয়ে দায় অনেকগুণ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ই–ভ্যালির চলতি সম্পদের পরিমাণ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির দেনার পরিমাণ ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সম্পদের চেয়ে ৬ গুণের বেশি এই দেনা পরিশোধ করার সক্ষমতা কোম্পানিটির নেই।
এসব তথ্য প্রকাশের পর ই–ভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে ই–ভ্যালির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “গণমাধ্যমের সূত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমরা জেনেছি। বিষয়টিকে আমরা স্বাগত জানাই।”
“শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে একটি এসওপি করা হবে, যাতে পণ্য ডেলিভারির আগে পেমেন্ট নেওয়া না হয়। ব্যাংক বা ক্রেডিট কার্ড যাদের আছে, তারা পেমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করবে।”
রাসেল আরও বলেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ই-কমার্স নীতিমালা নেই। ই-ভ্যালিও এই নীতিমালার কথা বলে আসছে। আজকের এ সিদ্ধান্ত সেই নীতিমালা প্রণয়নের প্রথম ধাপ বলেই তিনি বিশ্বাস করেন। এর ফলে গ্রাহক, বিক্রেতা, ই-কমার্সসহ পুরো ইকো সিস্টেমই উপকৃত হবে। আর এ সিদ্ধান্ত শুধু ই–ভ্যালি নয়, বরং সবার জন্যই প্রযোজ্য হবে।