জাতীয় নির্বাচনের বছরে অস্থিরতার আশঙ্কা পুঁজিবাজারে

শরীফ খিয়াম
2018.06.19
ঢাকা
ঢাকার মতিঝিলের স্টক এক্সচেঞ্জ ভবন। ঢাকার মতিঝিলের স্টক এক্সচেঞ্জ ভবন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮।
শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ

বাংলাদেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেনের নিম্নমুখী প্রবণতা এবং বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটের দরপতন অব্যাহত রয়েছে।

এজন্য নির্বাচনী বছরে সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় বাজারে ক্রেতা কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকেরা।

“বর্তমানে বাজারে ক্রেতা কমে গেছে, নেই বললেই চলে।” মন্তব্য করে বিগত দেড় দশক ধরে পুঁজিবাজার পর্যবেক্ষণকারী সিনিয়র সাংবাদিক আলতাফ মাসুদ এ প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন, “প্রত্যেক জাতীয় নির্বাচনের বছরেই এমনটা ঘটে।”

“গত মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রচুর টাকা তুলে নিয়েছে। এই মাসেও তাদের এই আচরণ অব্যাহত আছে,” বেনারকে বলেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ড. আবু আহমেদ।

সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশের (সিডিবিএল) প্রকাশিত তথ্যমতে চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনে দুই হাজার ১৮৪ বিনিয়োগকারী হারিয়েছে ঢাকার শেয়ারবাজার। এছাড়া চলতি মাসে বেনিফিশিয়ারি ওনার (বিও) অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক হাজার ৭০৬ জন পুরুষ এবং নারী ৪৯২ জন। এর মধ্যে ১০১ জন প্রবাসী।

আবু আহমেদ ও আলতাফ মাসুদের মতে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে মূলধন তুলে নেওয়ার কারণে স্থানীয় ক্রেতাদের লেনদেনও কমে গেছে।

এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম অনেক কমে যাওয়ার কারণে বিদেশিদের মধ্যে পুঁজি হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই তারা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তাঁরা।

তাঁদের মতে, অনেক বিদেশি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা থেকেও মূলধন সরিয়ে নিচ্ছেন।

“এর আগে কোনো নির্বাচনী বছরে শেয়ারবাজারে এত বিদেশি বিনিয়োগ ছিল না,” মন্তব্য করেন আবু আহমেদ।

ডিএসইর ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, ঈদ পরবর্তী প্রথম কার্যদিবসে, সোমবার এই বাজারের প্রধান সূচক ‘ডিএসই-এক্স’ ২৪ পয়েন্ট কমেছে। একই সঙ্গে কমে গেছে ৫২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর। তবে ঈদের আগে থেকে পতনের ধারাবাহিকতার মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার ডিএসইতে সূচক বেড়েছে তিন পয়েন্ট।

গত মাসে ডিএসই-তে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে ১৮ দিনই দরপতন হয়েছে। ওই সময় প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার পুঁজি হারিয়েছে বাজার।

এদিকে ঈদের ছুটি পূর্ব শেষ কার্যদিবসে গত সপ্তাহের মঙ্গলবারও সূচকের পাশাপাশি বেড়েছিল বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। সেদিন ডিএসইর ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ৩৮ পয়েন্ট বেড়ে ৫৩৬৫ পয়েন্টে অবস্থান করছিল।

চলতি সপ্তাহের প্রথম দিনের লেনদেন শেষে তা ৫৩৪১ পয়েন্টে নেমে এসেছিল, যা মঙ্গলবার তিন পয়েন্ট বেড়ে ৫৩৪৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

পতনের শীর্ষে ব্যাংক খাত

চলতি বছরে ১ জানুয়ারি থেকে মঙ্গলবার অবধি জ্বালানী ও বিবিধ খাত ছাড়া প্রতিটি সেক্টরের প্রতিষ্ঠান পুঁজি হারিয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাত সর্বোচ্চ ২৩ দশমিক এক শতাংশ মূলধন হারিয়েছে। এরপরই আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের অবস্থান। তারা ১৯ দশমিক দুই শতাংশ এবং সেবা ও রিয়েল এস্টেট খাত তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক তিন শতাংশ মূলধন হারিয়েছে।

আলতাফ বেনারকে বলেন, “২০১৭ সালের প্রায় পুরোটা সময়েই বিদেশিরা বিনিয়োগ করেছেন, যার বড় অংশই ছিল ব্যাংক শেয়ারে। ওই সময় ব্যাংক খাতের শেয়ার দরও গড়ে প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে।”

“বাজারে অস্থিরতা তৈরি হওয়ায় ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই তারা এ খাতের পুঁজি তুলে নেওয়া শুরু করে। এটিই ব্যাংক শেয়ারের দরপতনে বড় ভূমিকা রাখে,” বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এ ব্যাপারে একমত আবু আহমদও। আবুর হিসাবে ঢাকার শেয়ারবাজারে বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।

আবু আহমেদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সবচেয়ে কমেছে গ্রামীণ ফোনের শেয়ার দর। তারাই সর্বোচ্চ বিদেশি পুঁজি হারিয়েছে। একই সঙ্গে স্কয়ার ফার্মা, ব্র্যাক ব্যাংক, রেনেটা ফার্মারও বড় ধরনের পতন হয়েছে।

আবু বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা নতুন শেয়ার কেনার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত।” আলতাফ যোগ করেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অগ্রিম আমানত অনুপাত (এডিআর) কমানোর কারণেও লেনদেন কমেছে।”

চীনের সম্পৃক্ততায় অস্থিরতা

অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে বড় একটি চক্র বাজার নিয়ে খেলছে। যারা ডিএসই’র কৌশলগত অংশীদার হিসাবে চীনের নয়, ভারতের সম্পৃক্ততা চেয়েছিল। তারাই নানা কারসাজির মাধ্যমে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা মোঃ আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “চীনের স্টক এক্সচেঞ্জ সাংহাই ও শেনজেনের যৌথ কনসোর্টিয়াম ডিএসই’তে সক্রিয় হলে এ জাতীয় কারসাজির সুযোগ কমে যাবে।”

“চীনের সহায়তা ডিএসই’র সক্ষমতা বাড়াবে,” এমনটা আশা প্রকাশ করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক এই চেয়ারম্যান আরও বলেন, “এর ফলে অনেক নতুন বিদেশি এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।”

বাজার বিশ্লেষক আবুও বেনারকে বলেন, “ঢাকার পুঁজিবাজার পুনরায় চাঙা করতে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আনার ব্যবস্থা করতে হবে।” যদিও আলতাফের মতে, “নির্বাচনের আগে বাজার পরিস্থিতি বদলানোর সম্ভাবনা খুবই কম।”

চীনা অংশীদারদের অফিশিয়ালি সক্রিয় হওয়ার বিষয়টি ‘সময়সাপেক্ষ’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আগামী মাসে তারা ডিএসই’কে শেয়ারের দাম পরিশোধ করবে। তবে পরিচালন প্রক্রিয়ায় তাদের সম্পৃক্ত হতে কমপক্ষে আরও সাত-আট মাস লেগে যাবে।”

উল্লেখ্য, গত মে মাসে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে চীনের শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের যৌথ কনসোর্টিয়ামের কাছে ডিএসই’র ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রিতে চুক্তি সম্পন্ন হয়। এই মাসেই পুঁজিবাজারে বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ কমেছে ২৮২ কোটি টাকা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।