স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে বাংলাদেশ
2018.02.23
ঢাকা

আগামী মাসে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান।
তিনি বেনারকে বলেন, “মার্চ মাসে জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতিবিষয়ক কমিটি বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। আমরা আর দরিদ্র দেশ নই। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলেছি।”
“আমরা আগামী ২৩ মার্চ বাংলাদেশের এই অর্জন পালন করব। কারণ, এটি আমাদের দেশের ইতিহাসে একটি বিরাট অর্জন। দেশ হিসেবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ উজ্জ্বল হবে। বাংলাদেশের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ উন্মোচিত হবে,” বলেন আব্দুল মান্নান।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ১২-১৬ মার্চ জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতিবিষয়ক কমিটি এই ঘোষণা দেবে।
তিনটি মানদণ্ড
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উন্নীত হতে হলে কোনো দেশকে জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতিবিষয়ক কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়।
প্রথম শর্ত হলো মাথাপিছু আয় কমপক্ষে ১,০৪৬ ডলার হতে হবে।
এছাড়াও একটি দেশকে আরো দুটো সূচকে নির্ধারিত মান অর্জন করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে ‘মানব সম্পদ’ সূচক; যেখানে জীবনযাত্রার মান, শিক্ষা, শিশুমৃতুর মতো বিষয় এবং ‘অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার’ সূচকে জনসংখ্যার আকার, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পণ্য রপ্তানী কাঠামো, মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষি জাতীয় পণ্যের অবদান, উপকূলীয় অঞ্চলের জীবনযাত্রার মান ও প্রাকৃতিক দুযোর্গ মোকাবেলার মতো বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হয়।
তিনটি শর্তের যে কোনো দুটি পূরণ করলেই সেই দেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উন্নীত হবে।
স্বল্পোন্নত দেশ বিষয়ক জাতিসংঘের উপদেষ্টা ডেনিয়েল গে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে লিখেছেন, ইতিহাসে বাংলাদেশই প্রথম রাষ্ট্র যেটি তিনটি শর্তই পূরণ করে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।
২০১৫ সালের জুলাই মাসে মাথাপিছু আয় ১,৩১৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হওয়ায় বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ঘোষণা করে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু আয় ১,৬০২ ডলার। মানব সম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচক, দুটোতেই বাংলাদেশের রয়েছে প্রয়োজনীয় পয়েন্ট।
গত বছর অক্টোবরে জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতিবিষয়ক কমিটি একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফরে এসে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উন্নীত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে।
মার্চ মাসে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে উন্নয়ন নীতিবিষয়ক কমিটি পর্যালোচনা সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হবে।
উন্নয়ন নীতিবিষয়ক কমিটি তিন বছর পর ২০২১ সালে ওই তিন শর্ত বাংলাদেশ ঠিকমতো অব্যাহত রাখতে পারছে কি না সে বিষয়ে পর্যালোচনা করবে। বাংলাদেশ তার অর্জন বজায় রাখতে পারলে তার তিন বছর পর অর্থাৎ ২০২৪ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাদ যাবে।
দীর্ঘ মেয়াদে কিছু সুবিধা কমবে
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য দেশে বেশ কিছু পণ্য শুল্কমুক্তভাবে রপ্তানি করতে পারে।
তবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে বাংলাদেশ দীর্ঘ মেয়াদে সেইসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এছাড়া বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকেও আর কম হারে সুদ পাবে না বলে মন্তব্য করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
বর্তমানে বিশ্বব্যাংক শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে বাংলাদেশকে উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করে থাকে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে তখন আরও বেশি হারে সুদ দিতে হবে।
শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। রপ্তানির শতকরা ৯০ ভাগই তৈরি পোশাক ও নীটওয়ার পণ্য।
আব্দুল মান্নান বলেন, আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশে যে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানি সুবিধা পাই তা ২০২৮ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, আমাদের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য খাত বিশ্বে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার মতো সক্ষমতা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য ও গবেষক আসজাদুল কিবরিয়া বেনারকে বলেন, “উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করার পর বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য উন্নত দেশের বাজারে শুল্কমুক্ত যে রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে তা বন্ধ হয়ে যাবে তা নয়। দীর্ঘ মেয়াদে বন্ধ হতে পারে।”
“তবে সবকিছু নির্ভর করছে আমাদের দেশের দর-কষাকষির ক্ষমতার ওপর,” যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে তখন বর্তমান শতকরা শূন্য দশমিক ৭৫ এর চেয়ে বেশি রেটে উন্নয়ন সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। তবে হার কত হবে তা নির্ভর করছে দাতাদের সঙ্গে আমাদের দেশের দর-কষাকষির ওপর।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বেনারকে বলেন, “আমরা যদি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই তাহলে স্বল্পোন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য সুবিধা নেয়ার চিন্তা বাদ দিতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে টিকে থাকতে হবে,” তিনি বলেন।
ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশ আর গরিব নয়। আমাদের বাজেটের আকার চার লক্ষ কোটি টাকার বেশি। আমাদের প্রবৃদ্ধি দশক ধরে ছয়ের বেশি। তাই আমাদের ব্যবসায়ীসহ সকলের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।”