পূর্ব ঢাকাকে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব বিশ্বব্যাংকের
2018.07.05
ঢাকা
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সামাল দিতে এর পূর্ব অঞ্চলকে আধুনিকভাবে গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সেখানে অতিরিক্ত ৫০ লাখ লোকের বসবাসের সুযোগের পাশাপাশি ১৮ লাখ লোকের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলছে সংস্থাটি।
বাড্ডা, সাতারকুল, উত্তরা, ডুমনি, বরাইদ, পূর্বাচল এলাকাগুলো ঢাকার পূর্বাঞ্চল।
বিশ্বব্যাংকের এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে প্রায় দেড় হাজার কোটি মার্কিন ডলার খরচ করতে হবে। তবে এই বিনিয়োগের ফলে এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে, যা রাজধানীবাসীর মাথাপিছু আয়ও বাড়াবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের ‘টুওয়ার্ড গ্রেট ঢাকা: আ নিউ আরবান ডেভেলপমেন্ট প্যারাডাইম ইস্টওয়ার্ড’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
১৬০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নগরায়ণ পরিস্থিতি ও দুর্বলতা, রাজধানী ঢাকার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, ঢাকার উন্নয়নে জড়িত বিভিন্ন সংস্থার কাজের দুর্বলতা, রাজধানীর পশ্চিম ও পূর্ব অংশের তুলনা, ঢাকার অর্থনৈতিক অগ্রগতির সম্ভাবনা, ২০৩৫ সালে ঢাকার পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে—এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্যয় করতে হবে দেড় হাজার কোটি ডলার
ঢাকার পূর্ব অঞ্চলকে আধুনিকভাবে গড়ে তুলতে তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রথমত: বন্যার হাত থেকে ওই এলাকাকে রক্ষা করতে ও পানির গতি ঘোরাতে বালু নদীর তীরে একটি বাঁধ দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত: ক্রমবর্ধমান সাধারণ ট্রান্সপোর্ট ও পাবলিক ট্রান্সপোর্টের চলাচলের উন্নয়নে সমন্বয় সাধন করতে হবে। এ ছাড়া তৃতীয়ত: প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে আকর্ষণ করা জন্য শক্ত নীতি-পরিকল্পনার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।
এসব করা গেলে বাড়তি ৫০ লাখ মানুষ শহরে আরামে বসবাস করতে পারবে এবং ১৮ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, এই তিন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে ব্যয় প্রায় ১ হাজার ৫শ কোটি ডলার খরচ হতে পারে। তবে ওই অঞ্চলে ২০৩৫ সালের মধ্য সেখানে বছরে ৫ হাজার ৩শ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রম হবে।
এই অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ফলে রাজধানীবাসীর আয় বাড়বে জানিয়ে বিশ্বব্যাংক বলছে, এখন যেখানে রাজধানীবাসীদের মাথাপিছু আয় ৮ হাজার ডলার ২০৩৫ সাল নাগাদ সেটা ৯ হাজার ২০০ ডলারে পৌঁছবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবের প্রশংসা আসলেও বিদ্যমান বাস্তবতায় এর কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বেনারকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে অর্থের চেয়ে বড় সমস্যা প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতা।
“কারণ এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা লাগে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকায় সুপরিকল্পনা হলেও অনেক উদ্যোগ থেমে যায়। তাই বহু প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে সক্ষম কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হলে পূর্ব ঢাকাকে আধুনিক ঢাকায় রূপান্তর সম্ভব,” বলেন তিনি।
এদিকে ঢাকার পূর্ব অঞ্চলে জলাভূমিগুলো ধ্বংসের কাজ চলছে, প্রাইভেট কোম্পানির কাছেই অনেক জমি চলে যাচ্ছে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
“ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান ২০১০ সালের আগে করা সম্ভব হয়নি। আবার সেই প্ল্যানের অনেক কিছুই গ্রহণ করা হয়নি। ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান বাস্তবায়নই যেখানে জটিল সেখানে বিশ্বব্যাংক নতুন ঢাকাকে নিয়ে যে প্ল্যান করছে তা আসলে কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব,” প্রশ্ন তোলেন নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে বিশ্বব্যাংকের বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করেন ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মারুফ হোসেন।
এই নগর পরিকল্পনাবিদ বেনারকে বলেন, “যেভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে নতুন করে পরিকল্পনা হবে। রাজধানীর উন্নয়নের পাশাপাশি রাজধানী কেন্দ্রিক বিনিয়োগের বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। যাতে সবাই ঢাকামুখী না হয়।”
বিশ্বব্যাংকের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
তিনি বলেন, “ঢাকার উন্নয়নের সঙ্গে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান জড়িত। এগুলোতে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে।”
“ঢাকা শুধু বাংলাদেশের রাজধানী নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য ঢাকা। ২০২১ সাল বা ২০৪০ সালের ঢাকা মহানগরকে আমরা কোথায় নিতে চাই তা নিয়ে বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা আছে,” বলেন তিনি।
তবে ঢাকার উন্নয়নে দেশের ১১টি মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৫৪টি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে জানিয়ে স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেডের পরিচালক ইকবাল হাবিব বলেন, “এত প্রতিষ্ঠান না করে যদি ২/১টি প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাহলে কাজে গতি আসবে। সফলভাবে কাজ সম্পন্ন করা যাবে।”
দিনে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট
বাংলাদেশের উচ্চ-মধ্যম আয়ের লক্ষ্য অর্জনে ঢাকার আধুনিকায়ন অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক।
প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, যানজটের কারণে ঢাকায় দিনে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। বিগত ১০ বছরে যান চলাচলের গড় গতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে কমে ৭ কিলোমিটারে পর্যন্ত নেমে এসেছে। যেখানে পায়ে হেঁটে চলার গড় গতিই হচ্ছে ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার।
বিশ্বব্যাংক বলছে, ঢাকা মহানগরীর দ্রুত সম্প্রসারণের সঙ্গে ঢাকার নগর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সামঞ্জস্য না রাখার ফলে একটি বিশৃঙ্খল প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এ শহরে প্রায় ৩৫ লাখ বস্তিবাসীসহ অনেক অধিবাসী মৌলিক সেবা, অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে।
“প্রতিদিন যে হারে ঢাকায় মানুষ বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৩৫ সালে ঢাকার জনসংখ্যা সাড়ে ৩ কোটি হবে। ঢাকা এখন যেমন প্রচুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে,” প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে বলেন অক্সফোর্ডের প্রফেসর এনথনি ভেনাবল।
“অধিক জনসংখ্যা ও যানজটের কারণে ঢাকাবাসী বর্তমানে চরম দুর্ভোগে রয়েছে। পূর্ব ঢাকায় নগরায়ণ করা হলে সেখানে একটি মানসম্মত এলাকা তৈরি করা যাবে। তবে তার জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে,” বলেন বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্টিন রামা।