বিশ্ববাজারে সোনালি আঁশের বিপুল সম্ভাবনা
2017.03.30
ঢাকা

সম্প্রতি ইউরোপিয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশে পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন নিরুৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত ও প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে পাট নিয়ে আবারো আশাবাদী হয়ে উঠছে বাংলাদেশ।
তবে প্রস্তুতির অভাবে বাংলাদেশ এই সম্ভাবনার কতটুকু সুফল তুলতে পারবে তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের।
বিশ্বে জুট ভিসকস বা তন্তুর সাড়ে ৬ বিলিয়ন আর পাট ব্যাগের ৫শ বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে বলে জানান বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানিকারক ও ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না।
তিনি বেনারকে বলেন, “ইউরোপিয় ইউনিয়নে ২৮টি দেশ পলিথিন ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে ওই দেশগুলোতে বার্ষিক ৩৮ বিলিয়ন পাট ব্যাগের চাহিদার সৃষ্টি হবে।”
ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্ব বাজারে বছরে পাঁচ হাজার কোটি শপিং ব্যাগের চাহিদা রয়েছে।
প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের ঘোষণা অনুযায়ী অধিকাংশ দেশ প্রাকৃতিক আঁশ নির্ভর পণ্যের দিকে ঝুঁকলে ২০২০ সালের মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেই দেড় হাজার কোটি ডলারের শপিং ব্যাগের বাজার তৈরি হবে বলে মনে করে আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক আঁশ সমিতি।
উল্লেখ্য যে, গত বছরের নভেম্বর থেকে বিভিন্ন দেশে ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের সিদ্ধান্ত কার্যকর শুরু হয়েছে।
“আর শুধু দেশের ভেতরেই ৫০ কেজি আকারের ২৯২ কোটি পাট বস্তার চাহিদা রয়েছে,” বেনারকে বলেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
আশাবাদ ও বাস্তবতা
একসময় বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের প্রধান পাট রপ্তানিকারক। বাংলাদেশের বিশ্বজনীন পরিচয় ছিল ‘সোনালি আঁশের দেশ’ হিসেবে। কিন্তু কৃত্রিম আঁশ ও পলিথিনের আবির্ভাব এবং নতুন বাজারনীতি পাটকে প্রতিযোগিতায় কোণঠাসা করে ফেলে।
উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিজের বাজারটিও পাটের জন্য সংরক্ষণ করতে পারেনি। একে একে বন্ধ হয়ে যায় পাটকলগুলো।
তবে আবারও পাট থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের কথাও ভাবছে সরকার।
এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেন, “ভবিষ্যতে পাটের পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বছরে ৫ হাজার কোটি ডলার আয় হবে।”
তবে সম্ভাবনা থাকলেও মন্ত্রীর এই স্বপ্ন বর্তমান বাস্তবতা থেকে এখনো অনেক দূরে বলে মত বিশ্লেষকদের।
চলতি বছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৯৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা ৭ হাজার ৭১২ কোটি টাকা।
পাটের পণ্য রপ্তানি বাড়লেও এ বছর পাট রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে। কাঁচা পাটের প্রধান ক্রেতা ভারত বিশেষ শুল্ক (অ্যান্টি ডাম্পিং) আরোপ করায় রপ্তানিতে প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
দরকার বিশেষায়িত পাটকল
বিশাল এই বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের শক্তিশালী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে বিশেষায়িত পাটকল প্রতিষ্ঠায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার বলে মনে করেন রপ্তানিকারকেরা।
“পাট খাতে সরকার যে প্রণোদনা দেয়, এতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। এমনভাবে সহায়তা করতে হবে যা কাজে লাগিয়ে লাভবান হতে পারে,” বলেন ড. গোলাম মোয়াজ্জেম।
তাঁর মতে “সম্ভাবনার শতভাগ কাজে লাগাতে পণ্যের মানোন্নয়নের পাশাপাশি জোর দিতে হবে অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণেও।”
তবে উন্নত পাট পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার প্রায় পুরোটাই ভারতীয় উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট কিনে তা প্রক্রিয়াজাত করে ভালো ডিজাইন ও নকশার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি করছে ভারত।
দেশের সেরা পাট পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জনতা জুট মিলসের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহমুদুল হক বলেছেন, “আমরা এই বাজারে সবেমাত্র প্রবেশ করতে শুরু করেছি। এই খাতে ভালো বিনিয়োগ দরকার। সরকারের সহায়তাও দরকার।”
পাটের বহুমুখী ব্যবহার
পাট বর্তমানে কেবল দড়ি, চট বা বস্তা তৈরির আঁশ নয়। পাটের ব্যবহার এখন বহুমুখী। পাট থেকে বর্তমানে ১৩০ ধরনের পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। সর্বাধুনিক মডেলের গাড়ির বডি ও অন্যান্য উপাদান তৈরির কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশের পাট।
বাসাবাড়ির আসবাব থেকে শুরু করে উন্নত শাড়ি, স্যুট, প্যান্ট এমনকি জিন্স বা ডেনিমও পাট থেকে তৈরি হচ্ছে। পাট শলা পোড়ানো কার্বন দিয়ে প্রিন্টারের কালি তৈরি হচ্ছে। পাটের পাতা থেকে চায়ের মতো পানীয় উৎপাদন হচ্ছে।
সরকারি প্রণোদনা
পাট শিল্পের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী মির্জা আজম।
তিনি বলেন, “পাট সুরক্ষা ও প্রণোদনায় আইন করা হয়েছে। ১৭টি পণ্য প্যাকেজিং এ শুধু পাট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বন্ধ পাটকলগুলো চালু করা হচ্ছে। পলিথিন ব্যাগের অবাধ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কৃষকদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ বীজ, সার সরবরাহ করছি।”
সরকারি জুট মিলস করপোরেশন বিজেএমসি’র চেয়ারম্যান মো. মাহমুদুল হাসান বেনারকে বলেন, “সরকারি প্রণোদনায় আজ পাট খাতে সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। পাট খাতে নগদ সহায়তা দিয়ে এর বিকাশ অব্যাহত রাখতে হবে।”
বাস্তবায়নের চিত্র হতাশাব্যঞ্জক
সরকারি এসব সিদ্ধান্ত ইতিবাচক বলে মনে করেন কৃষিবিদ ও পাট গবেষক ড. হুমায়ুন কবীর। তবে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চিত্র অনেক ক্ষেত্রেই হতাশাব্যঞ্জক বলেও জানান তিনি।
“নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন ভিন্ন চেহারা ও আকৃতিতে বাজারে দাপটের সঙ্গেই উপস্থিত। বাধ্যতামূলক ক্ষেত্রেও পাটের ব্যাগের ব্যবহার পুরোপুরি নিশ্চিত হচ্ছে না,” বেনারকে বলেন হুমায়ুন কবীর।
পাটের দেশে পলিথিন
আশির দশক থেকে বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার শুরু। নব্বইয়ের দশকে এর ব্যবহার ব্যাপক আকার ধারণ করে। অপচনশীল পলিথিন অতি ব্যবহারের কারণে ১৯৯৮ সালের বন্যায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে পলিথিন নিষিদ্ধের দাবি জোরালো হয়। পরে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাত ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাট থেকে পরিবেশবান্ধব পলিথিন আবিষ্কার করেছেন। এই পলিথিন প্লাস্টিকের তৈরি পলিথিনের চেয়ে উৎকৃষ্ট বলে দাবি করেছেন উদ্যোক্তারা; যা ৬০ দিনের মধ্যে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। পাট থেকে পলিথিন তৈরির কার্যক্রমও শুরু করা হয়েছে।
বিজেএমসির উপব্যবস্থাপক নৃপেন্দ্রনাথ হিরা বেনারকে বলেছেন, “আশা করছি আগামী জুন মাসে এই ব্যাগ বাজারে আসবে।”