জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিশাল উন্নয়ন কর্মসূচি
2017.05.16
ঢাকা

পুরোনো প্রকল্পগুলোর জন্য বড় বরাদ্দ রেখে আসন্ন অর্থবছরের জন্য বিশাল এক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করেছে সরকার, যা আকারে চলতি বছরের এডিপির তুলনায় শতকরা ৩৯ ভাগ বড়।
২০১৯ সালে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের আগেই যাতে বাস্তবায়ন করা যায় সেই লক্ষ্য মাথায় রেখে এডিপিতে নতুন প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই রাখা হয়েছে ছোট ও স্বল্প মেয়াদি। এডিপিতে মোট ১ হাজার ৩১১টি প্রকল্পের মধ্যে নতুন প্রকল্পের সংখ্যা ৯০টি।
তবে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
“আগের প্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই নতুন প্রকল্প বেশি আসেনি,” বেনারের কাছে অভিমত প্রকাশ করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেছেন, “উন্নয়ন কর্মসূচি যাই নেওয়া হোক, তা বাস্তবায়ন করাটাই বড় প্রশ্ন। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন ব্যর্থতার কারণে সময় এবং ব্যয় দুটোই বেড়ে যাচ্ছে।”
তবে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, “এডিপির আকার দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমাদের চাহিদা বাড়ছে, রাজস্বও বাড়ছে। সুতরাং এডিপি বাস্তবায়ন করতে পারব না, এটা বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।”
এর আগে বাজেট প্রণয়ন ও প্রকল্প নির্ধারণে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন এবং ভোটারদের কাছে গণপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতিগুলো বিবেচনায় রাখার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারি দপ্তরগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
বৃহৎ ও পুরোনো প্রকল্প
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ১ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করে।
চলতি (২০১৬-১৭) অর্থবছরে মোট জাতীয় বাজেট ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার মধ্যে এডিপির আকার ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। সে তুলনায় আগামী অর্থবছরে এডিপিতে ৪২ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এখন পর্যন্ত আসন্ন জাতীয় বাজেটের পরিমাণ জানা না গেলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
প্রসঙ্গত আগামী ৩০ মে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হবে।
এডিপিতে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দ ৯৬ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ৫৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
উন্নয়ন বাজেটে শুধু রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের জন্যই বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৫ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে ৭ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
মেট্রোরেল নির্মাণে ৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে ১ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ২ হাজার ২২০ কোটি এবং কাঁচপুর মেঘনা এবং গোমতি দ্বিতীয় সেতু নির্মাণে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে।
খাত ভিত্তিক বরাদ্দ
এবার এডিপিতে খাত ভিত্তিক সর্বোচ্চ ৪১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা বা প্রায় ২৭ ভাগ বরাদ্দ রাখা হয়েছে পরিবহন খাতে। পদ্মা সেতু, পদ্মা রেল সংযোগ, মেট্রোরেল ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণসহ অনেক মেগা প্রকল্পের চাহিদা পূরণে এ বিশাল বরাদ্দ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ বিদ্যুতে ১৮ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া শিক্ষা ও ধর্ম খাতে ১৬ হাজার ৬৭৩ কোটি, ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ণ খাতে ১৪ হাজার ৯৪৯ কোটি, বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে ১৪ হাজার ৪৫০ কোটি এবং কৃষিতে ৬ হাজার ৬ কোটি টাকা টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অর্থনীতির অবস্থা ও সম্ভাবনা
গত রবিবার এনইসি সভায় উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী চলতি (২০১৬-১৭) অর্থবছরের ১০ মাসে বাংলাদেশ ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্থনৈতিক (মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের রেকর্ড করেছে। আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হবে বলে আশা করা হয়েছে।
ওই দিনই বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর হালনাগাদ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাবটাকেই বাস্তবানুগ বলে মনে করছেন ড. মির্জ্জা আজিজ।
তিনি বলেন, হিসাবের এই তারতম্য সত্ত্বেও অর্থনীতিতে বাংলাদেশ ভালো করছে—এ বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরি বেনারকে বলেন, “কাগজে-কলমে প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে মনে হলেও আত্মতুষ্টির কারণ নাই। কোন কোন খাত এবং উপখাতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে এবং কেন বেড়েছে তা আরও পর্যালোচনা করা উচিত। নইলে এসব খাতে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কঠিন হবে।”
অর্থনীতির জন্য বড় চাপ
অগ্রগতি সত্ত্বেও বিনিয়োগে স্থবিরতা, রপ্তানিতে মন্দাভাব এবং প্রবাসী আয় কমে যাওয়াকে অর্থনীতির জন্য বড় চাপ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তা ছাড়া খেলাপি ঋণের হার বৃদ্ধিসহ ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন তারা।
ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এ ক্রমবর্ধমান হার ধরে রাখতে মানবসম্পদ উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। তবে এটি হতে হবে বাস্তবমুখী শিক্ষার আলোকে।”
জাহিদ হোসেনের মতে, ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং তা টেকসই রাখতে হলে বিনিয়োগের পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বাড়াতে হবে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ।