জাপানের সাথে বাংলাদেশের ২৫০ কোটি ডলার উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তি সই
2019.05.29
ঢাকা

বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে উন্নয়নের লক্ষ্যে আড়াই শ কোটি বা ২.৫ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) চুক্তি স্বাক্ষর করেছে জাপান। এটি দু’দেশের মধ্যকার ৪০তম উন্নয়ন সহায়তা চুক্তি।
বুধবার টোকিওতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে তাঁদের উপস্থিতিতে এই ঋণ চুক্তি সই হয়। সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, পরে সেখানে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক।
প্রধানমন্ত্রী জাপান যাওয়ার আগে ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাংলাদেশে যোগাযোগ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত এবং শিল্পায়নের জন্য এ সহায়তা দিচ্ছে জাপান। ৪০তম এই প্যাকেজ গতবারের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি।
জাপানের এই ঋণ সহায়তা দিয়ে মাতার বাড়ি সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-১), বিদেশি বিনিয়োগ সহায়ক প্রকল্প (২), জ্বালানি দক্ষতা ও সুরক্ষা সহায়ক প্রকল্প (পর্যায়-২) ও মাতার বাড়ি আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে (৫) অর্থায়ন করা হবে।
বাংলাদেশে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৩৬ হাজার কোটি টাকার মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বন্দর এবং ২২ হাজার কোটি টাকার মেট্রোরেল প্রকল্পে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে জাপান।
এবারের ওডিএ চুক্তির মধ্য দিয়ে ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে জাপানের মোট সহায়তা দাঁড়াল এক হাজার ১৩০ কোটি ডলারে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে জাপান। দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়েও সম্মত হন দুই প্রধানমন্ত্রী।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই নানা ধরনের সহায়তা দিয়ে আসছে জাপান। এই অর্থনৈতিক সহায়তাও তারই অব্যাহত ধারা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাপানের সমর্থনও ইতিবাচক বলে মনে করছেন তাঁরা।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির বেনারকে বলেন, “১৯৭২ সাল থেকে জাপান সবক্ষেত্রে বহুমাত্রিকভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে সাহায্য সহযোগিতা করছে। এতে গত সাড়ে চার দশক ধরে আমরা অনেক উপকৃত হয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর সফরে যে চুক্তিগুলো সই হয়েছে এটা সেই ধারাবাহিকতারই অংশ বিশেষ।”
“জাপান বাংলাদেশের সাথে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জড়িত নয়। তারা রাজনীতিকরণ বা এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেয় না,” বলেন তিনি।
“বাংলাদেশে এখন অবকাঠামোগত যেসব উন্নয়ন হচ্ছে তাতে চীন-ভারতের মতো অর্থনৈতিক শক্তি বিনিয়োগ করছে। ভূমিকা বাড়ছে গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী জাপানেরও, যা এখন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন,” বেনারকে বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এহসানুল হক।
জাপান, সৌদি আরব ও ফিনল্যান্ডে ১২ দিনের সফরের উদ্দেশ্যে গত মঙ্গলবার জাপান পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সেখানে থাকবেন তিন দিন। বুধবার সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা।
বাসস জানায়, বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নত হওয়ার সব মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি।”
“এই লক্ষ্য অর্জনে জাপান সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে বলে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশ-জাপান বিজনেস ফোরামের (বিজেবিএফ) বৈঠকে জাপানের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বানও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই দেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য সম্পর্ককে উচ্চতর পর্যায়ে নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক সাংবাদিকদের জানান, সমুদ্র থেকে গ্যাস তোলার বিষয়ে জাপানের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ থেকে দক্ষ মানবসম্পদ নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশে মানবসম্পদ উন্নয়ন একাডেমি করারও প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী।
এসব বিষয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন বলে জানান শহীদুল হক।
সচিব জানান, দুই প্রধানমন্ত্রী ২০২২ সালে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকী সামনে রেখে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সমর্থন
এদিকে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে জাপান।
মিয়ানমার থেকে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বিতাড়নের জেরে সৃষ্ট সংকট থেকে উত্তরণে ‘টেকসই’ সমাধানের বিষয়ে দুই নেতা আলোচনা করেছেন মর্মে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেওয়া বিবৃতি বলা হয়।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “জাপান অনুধাবন করতে পেরেছে, বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের তাদের জন্মভূমি মিয়ানমারে নিরাপদে ও সম্মানজনকভাবে প্রত্যাবাসনের মধ্যেই এই সংকটের সমাধান নিহিত।”
তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এহসানুল হক বলছিলেন, “রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানকে খুব একটা উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক সমর্থন থাকলেও এ বিষয়ে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো অবস্থান নেয়নি দেশটি।”
“দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের মাধ্যমে জাপানের ভূমিকা নেওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হলো বলা যায়। কারণ, জাপান আন্তর্জাতিকভাবে যেকোনো ভূমিকা যুক্তিপূর্ণভাবে নিয়ে থাকে,” বলেন তিনি।
“তবে মিয়ানমারে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থও রয়েছে। তাই জাপান এই ইস্যুতে মিয়ানমারকে কতটুকু চাপ দেবে তা নির্ভর করবে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর,” মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে জাপান মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করলে দেশটি কিছুটা হলেও তা শুনতে পারে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির।
তিনি বলেন, “সেটাও নির্ভর করবে জাপানের প্রধানমন্ত্রী কতটা চাপ প্রয়োগ করবেন তাঁর ওপরে।”