পশ্চিমবঙ্গে ধর্মভিত্তিক স্কুলের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক
2017.03.14
কলকাতা

হিন্দু সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ছত্র ছায়ায় পরিচালিত স্কুলগুলোর দ্রুত প্রসারের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
এসব স্কুলের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতায় মদদ দেওয়া ও নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমের বাইরে গিয়ে পড়ানোর অভিযোগ তুলেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও শিক্ষাবিদদের একাংশ। বিষয়টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর নজরে এসেছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই ধরনের ১২৫টি স্কুলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, ধর্মের ভিত্তিতে রাজ্যে কোনো স্কুল চলতে দেওয়া হবে না।
গত সপ্তাহে রাজ্য বিধানসভায় সিপিআইএম বিধায়ক মানস মুখোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, বিবেকানন্দ বিদ্যাবিকাশ পরিষদের অধীনে প্রত্যন্ত এলাকায় স্কুল খোলা হয়েছে। এই স্কুলগুলোর পড়াশোনার পরিকাঠামো নির্দিষ্ট জাতি ও সম্প্রদায়ের ওপরে যথেষ্ট প্রভাব ফেলছে।
তিনি বলেন, এই স্কুলগুলোতে শিশুমনকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। সরকারি সিলেবাসের বাইরে গিয়ে এই বিদ্যালয়গুলো পঠন-পাঠন হচ্ছে। মূলত ধর্মকে গুরুত্ব দিয়ে পড়াশোনা করানো হচ্ছে।
এই অভিযোগের উত্তরে রাজ্য শিক্ষামন্ত্রী বলেন, স্কুলগুলোর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে তারা কেন সরকার নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমের বাইরে গিয়ে পড়াচ্ছেন। উপযুক্ত উত্তর পাওয়া না গেলে স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে বলেও তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, দেখা হবে স্কুলের পাঠ্যক্রমে ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় বিভাজনের মতো বিষয়গুলো রয়েছে কিনা।
শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং উদ্বেগজনক জানিয়ে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, আরএসএসের ছত্র ছায়ায় পরিচালিত স্কুলের সংখ্যা রাজ্যে বাড়ছে। তবে গত বছরই এই ধরনের ৫টি স্কুলকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
আরএসএস পরিচালিত স্কুল
পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সংগঠন পরিচালিত ৩২৬টি স্কুল রয়েছে। বেশ কয়েকটি স্কুল রজতজয়ন্তীও পালন করেছে বা করতে চলেছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের কোশিয়াড়ির সরস্বতী শিশু মন্দির গত বৃহস্পতিবার থেকেই রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠান পালন শুরু হয়েছে।
আরএসএসের ছত্র ছায়ায় থাকা লখনউয়ের বিদ্যা ভারতী অখিল ভারতীয় শিক্ষা সংস্থানের অনুমোদিত সারদা শিশু তীর্থ, সরস্বতী শিশু মন্দির ও বিবেকানন্দ বিদ্যা বিকাশ পরিষদ নামের তিনটি ট্রাস্টই প্রধানত পশ্চিমবঙ্গে এই স্কুলগুলো পরিচালনা করে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত এই সব স্কুলে পড়াশোনা করানো হয়।
এদের ঘোষিত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, এমন এক রাষ্ট্রীয় শিক্ষা প্রণালির বিকাশ, যার দ্বারা এমন যুব সমাজ গড়ে উঠবে যারা হিন্দুত্বনিষ্ঠ, দেশ ভক্তিতে পরিপূর্ণ, শারীরিক, প্রাণিক, মানসিক, বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক চেতনায় পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হবে।
বিদ্যা বিকাশ পরিষদের ওয়েব সাইটে বলা হয়েছে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হিন্দু মানসিকতা তৈরি করে এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে। এর পাশাপাশি ছাত্রদের মধ্যে ধর্মীয় মনোভাব গড়ে তোলা হবে।
বিবেকানন্দ বিদ্যা বিকাশ পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তাদের ৩২৬টি স্কুল রয়েছে। গত এক বছরে নতুন ১২টি স্কুল খোলা হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর ও কোচবিহারে।
২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সব স্কুলের ছাত্রসংখ্যা ছিল ৭৪ হাজার ৯৯৬। ২০১৫ সালের তুলনায় ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ ২৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ বলে দাবি করা হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, ‘আমাদের কাছে যা খবর, তাতে এই ধরনের ১২৫টি স্কুল রয়েছে। এর মধ্যে ৯৬টির অনুমোদন নেই। তবে তার দাবি, সেগুলির বেশির ভাগই অনুমোদন পেয়েছে বাম জমানায়। তৃণমূল আমলে সম্ভবত ১৩টি স্কুল অনুমোদন পেয়েছে।’
ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে কয়েকটি স্কুলে তদন্ত চালিয়ে তাদের অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।
তবে তদন্তে সুনির্দিষ্ট কী পাওয়া গেছে সে বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী কোনো মন্তব্য করেননি।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ সাংবাদিকদের বলেন, প্রতি মাসেই তাদের স্কুলের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের স্কুলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর থেকে।
বিবেকানন্দ বিদ্যা বিকাশ পরিষদের সম্পাদক গোপাল হালদার বেনারকে বলেন, “রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বোর্ডের অনুমোদিত পাঠ্যক্রম অনুসারে এই স্কুলগুলো চলে। বেআইনি কিছুই পড়ানো হয় না।”
তবে পরিষদের পূর্ব ক্ষেত্রের সভাপতি সাধন মজুমদার বেনারকে বলেন, “আমাদের স্কুলগুলোতে পড়াশোনার ধরন একটু আলাদা। নিয়মিত শরীরচর্চা, যোগাভ্যাস, সংগীত, অঙ্কন ও সংস্কৃত শেখানো হয়।”
তিনি আরও বলেন, পড়ুয়াদের প্রতিদিন সরস্বতী প্রার্থনা ও দেশবন্দনা করতে হয়।
বিজেপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শারীরিক ও মানসিক গঠনের পাশাপাশি এই সব স্কুলে গীতা, বেদ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থও নিয়মিত পড়ানো হয়।
মাথাব্যথার কারণ
পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্বের অনুসারী এই স্কুল নিয়ে বিজেপি বাদে সিপিআইএম, কংগ্রেসসহ সব রাজনৈতিক দলই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই উদ্বেগের সঙ্গে সহমত তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারাও।
শিক্ষাবিদরাও মনে করেন, এই সব স্কুলের মাধ্যমে গেরুয়াকরণের ব্যবস্থা পাকা করা হচ্ছে। পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি বিশেষ একটি ধর্মকে গুরুত্ব দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সংকীর্ণতা চর্চার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
কংগ্রেস বিধায়ক অপূর্ব সরকার বেনারকে বলেছেন, ওই স্কুলগুলো গোপন রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে চালানো হয়। এদের ছুটির তালিকাও সরকারি ছুটির তালিকার সঙ্গে মেলে না।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ সাংবাদিকদের শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, এই স্কুলগুলো নিয়ে যদি তদন্ত করতে হয়, তাহলে মাদ্রাসায় কী পড়ানো হচ্ছে তাও খতিয়ে দেখা উচিত।
তিনি আরও বলেন, উপযুক্ত সরকারি স্কুল না থাকার জন্যই সংঘ পরিচালিত স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীরা যাচ্ছে। বরং সরকারের উচিত এই উদ্যোগের প্রশংসা করা।
তবে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক অঞ্জন বেরা সংঘ পরিচালিত স্কুলগুলো নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়ে বেনারকে বলেন, এই স্কুলগুলোতে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার চর্চা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি মনে করেন, সারা দেশে যে সাম্প্রদায়িক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা হচ্ছে, তাকে আরও মজবুত করতে স্কুলের ছদ্মবেশে সংঘ পরিবার শিশু মনকে প্রভাবিত করে যাচ্ছে।