পথ চেয়ে বসে থাকা স্বজনদের কাছে যাচ্ছে মানুষ
2018.06.15
ঢাকা
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের দুপুর বেলা। ভ্যাপসা গরম। বাবার কোলে বসে ছোট্ট সাফওয়ান ঘামছে অনবরত। মা অনবরত রুমাল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিচ্ছেন। উপকূল কখন প্ল্যাটফর্মে আসবে আর কখন পৌঁছাবে নোয়াখালী কেউ বলতে পারছেন না।
এত কষ্ট করে ঢাকা ছাড়ার দরকারটা কী? জবাবে সাফওয়ানের বাবা–মা বললেন, “নাতির জন্য দাদা–দাদি পথ চেয়ে বসে আছেন।”
“ব্যবসা–বাণিজ্যে ব্যস্ত হয়ে গেছি। বছরে দুই ঈদে বাড়ি যাই। গোটা বছর আব্বা–আম্মা নাতির জন্য অপেক্ষা করেন। বাসায় কখন পৌঁছাব জানি না। পৌঁছার আগ পর্যন্ত ফোন আসতেই থাকবে। নাতিকে কোলে নিয়ে শান্তি,” সাখাওয়াৎ হোসেন সোহেল বলছিলেন।
কাজের প্রয়োজনে যাঁরা ঢাকায় থাকেন, ঈদের সময় তাঁরা অপেক্ষায় থাকা স্বজনের কাছে ফেরেন। বাসে–ট্রেনে–লঞ্চে এমনকি আকাশপথেও ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা। যে যেভাবে পারছেন ঈদ উৎসব পালনে ঢাকা ছাড়ছেন। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে গতকালও হাজারো মানুষকে প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। ব্যস্ত ছিল ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল দল, পুলিশ ও র্যাবও।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার সিতাংশু চক্রবর্তীর দম ফেলার ফুরসত নেই।
“গত ১০ তারিখ থেকে প্রতিদিন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রায় এক লাখ মানুষ বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটছেন। অন্যান্য সময় এই স্টেশন থেকে পঞ্চাশ হাজারের মতো মানুষ যাতায়াত করেন,” বেনারকে বলেন সিতাংশু চক্রবর্তী।
শুধু যে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনেই ভিড়ের বাড়াবাড়ি, তা–ই নয়। মহাখালী, যাত্রাবাড়ী–সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাসস্ট্যান্ড যেখান থেকে দূরপাল্লার বাস ছাড়ে সেখানেও ছিল বহু মানুষের ভিড়।
যাঁরা বহুকাল আগেই গ্রাম ছেড়ে এসেছেন, তাঁরা যাচ্ছেন নানান পর্যটন কেন্দ্রে। কেউ দেশের ভেতরে আবার কেউবা বাইরে। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) এর অন্যতম পরিচালক সৈয়দ সাফাত উদ্দিন আহমেদ তমাল বলছিলেন, বছর পাঁচেক ধরেই পর্যটন এলাকায় ঈদ করতে যাওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে মানুষের। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সপ্তাহখানেক আগে থেকে ট্যুর অপারেটররা আর কোনো বুকিং নিচ্ছেন না। কক্সবাজারে ঈদের তিন দিনে ঢাকা থেকে যাওয়া প্রায় দেড় লাখ মানুষ অবস্থান করবেন।
“সুন্দরবন ছাড়া দেশের ভেতর এখন আর কোনো পর্যটন কেন্দ্র নেই যেখানে গিয়ে থাকা–খাওয়া–ঘোরার দায়িত্ব নিতে পারি আমরা। সব বুকড। দেশের বাইরে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় যাচ্ছে মানুষ। আড়াইহাজার মানুষ ঢাকা থেকে বালিতে ঈদ করতে যাচ্ছেন এবার,” সাফাত বেনারনিউজকে বলছিলেন।
কেনাকাটা এই ঈদের বড় অংশ। বিপণি বিতানগুলোয় এখনো বেশ ভিড়। শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায় মানুষ ব্যস্ত। ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিপণি বিতান ছেড়ে মানুষ পোলাও চাল, সেমাই–চিনি, মাংস বিক্রেতাদের কাছে ছুটছেন। ঘর গোছানোর কাজে ব্যস্ত কেউ কেউ।
পান্থপথ বউবাজারের মাংস বিক্রেতা কাওসার খানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল।
“পুরো রোজার মাসেই মাংস বিক্রি হয়। শেষ সময়টায় অন্যান্য সময়ের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি মাংস বিক্রি হয়। আগে থেকেই অনেকে অর্ডার দিয়ে গেছেন। সেইরকম করে আয়োজন করতে হয়েছে। চানরাত (ঈদের আগের রাত) পর্যন্ত চলবে এই ব্যস্ততা,” কাওসার বলছিলেন।
বাইরের ভিড় ভাট্টা এড়িয়ে অনেকে এবার অনলাইনে কেনাকাটা সারছেন। বিভিন্ন জনপ্রিয় অ্যাপের সহযোগিতা নিচ্ছেন তাঁরা। পোশাক, গয়নাগাটির পাশাপাশি ঘরের কাজেও ঈদ উপলক্ষে সেবা নিয়েছেন অনেকে। শারমিনা সিরাজ তাঁদের একজন।
পেশায় ইন্টেরিয়র ডিজাইনার শারমিনা বেনারনিউজকে বলছিলেন, “আমি সেবা অ্যাপ ইনস্টল করেছি। কল করতেই ওরা এসে আমার কিচেন হুডসহ রান্নাঘরের সব যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে। ঘরদোরের আসবাবপত্র সরিয়ে ঝাড়ামোছার কাজটাও এদের কাছ থেকেই নেব ঈদের আগে,” শারমিনা বেনারনিউজকে বলছিলেন।
এবার ঈদের আনন্দে মানুষের বাড়তি পাওনা বিশ্বকাপ ফুটবল। ঈদের দুদিন আগে আনুষ্ঠানিকভাবে পর্দা উঠছে এই আসরের। ঈদের দিনে আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হচ্ছে আইসল্যান্ডের। বাংলাদেশের বড় অংশ মানুষ ফুটবলে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল এই দুই শিবিরে বিভক্ত। ঈদের দিনে ঘরে আরাম করে খেলা দেখার প্রস্তুতি নিয়েছেন কেউ কেউ। অনেকেই ঈদের পোশাকের সঙ্গে সঙ্গে প্রিয় দলের জার্সি কিনেছেন, উপহারও দিয়েছেন একে অপরকে।
পুরো দেশ যখন আনন্দ উৎসবের প্রস্তুতি নেওয়ায় ব্যস্ত, তখন পুলিশ ব্যস্ত ঈদটা নির্বিঘ্ন করতে। বছর দু-এক আগে দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাত কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় আইএসপন্থী দল নব্য জেএমবি হামলা চালিয়েছিল। ঈদের জামাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো আছাদুজ্জান মিয়া গতকাল জাতীয় ঈদগাহের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখতে যান। তিনি বলেন, ঈদগাহের প্রতিটি জায়গা সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। পোশাকে ও সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন থাকবে, থাকবে সোয়াত, বোম ডিসপোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াড ইউনিটও। ঈদগাহে ঢোকার আগে মুসল্লিদের দুই দফা তল্লাশি করা হবে। জায়নামাজ ও ছাতা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে কেউ ঈদগাহে আসতে পারবেন না।